প্রচ্ছদ আর্ন্তজাতিক ভুয়া বিচারক হিসেবে ৯ বছর আদালত পরিচালনা করেন তিনি, ধরা খেলেন যেভাবে

ভুয়া বিচারক হিসেবে ৯ বছর আদালত পরিচালনা করেন তিনি, ধরা খেলেন যেভাবে

আর্ন্তজাতিক: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভুয়া বিচারকের বিচারকার্য পরিচালনা করা নতুন কোনো খবর নয়। অনেক সময় তারা গ্রেপ্তার হয়ে মিডিয়ার খবর হয়েছেন। তবে এবার ভারতে একই ধরনের ঘটনা ঘটলেও রয়েছে চাঞ্চল্যকর রহস্য। ভুয়া বিচারক হিসেবে দীর্ঘ নয় বছর দায়িত্ব পালন করেছেন ওই ব্যক্তি।  গুজরাটের রাজধানী গান্ধীনগরের একটা ব্যস্ত এলাকায় তৈরি শপিং সেন্টারে সকাল থেকেই বহু মানুষ সরু সিঁড়িতে বসে রয়েছেন। অপেক্ষা করছেন কখন তাদের পালা আসবে। কিছুক্ষণ পরে আদালতের ক্লার্কের উর্দিধারী এক ব্যক্তি উচ্চস্বরে চিৎকার করলে, অপেক্ষারত মানুষেরা তাদের আইনজীবীদের নিয়ে ছুটে যান। বিচারকের চেয়ারে বসা ব্যক্তি দুই পক্ষের যুক্তি-তর্ক শোনেন এবং রায় ঘোষণা করেন। প্রথম নজরে, এই দৃশ্য দেখে মনে হবে যে আদালতের স্বাভাবিক কাজকর্ম চলছে। কিন্তু সন্ধ্যা নাগাদ পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। সন্ধ্যায়, আদালতের কাজ শেষ হলে, বিচারক ক্লায়েন্ট বা মক্কেলদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন এবং তাদের পক্ষে রায় দেয়ার জন্য টাকাও দাবি করেন। এরপর যদি হিসেব মতো সব মিলে যায় আর চুক্তি পাকা হয়, তাহলে রায় সেই মক্কেলের পক্ষে দেয়া হয়। ভুয়া আদালত পরিচালনার দায়ে মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান নামের ওই ব্যক্তিকে সম্প্রতি আদালতে পেশ করে পুলিশ। সেখানেও তিনি নিজেকে সালিশি আদালতের বিচারক হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। শুধু তাই নয়, বিচারকের কাছে অভিযোগ করেন, পুলিশ তাকে মারধর করেছে এবং বাধ্য করেছে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ স্বীকার করতে।

সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে গ্রেপ্তারকৃত মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ানের বিরুদ্ধে ভুয়া আদালত গঠন এবং জালিয়াতি করে রায় দেয়ার অভিযোগে অবিলম্বে প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের মামলা দায়ের করার নির্দেশ দেন সিটি সিভিল কোর্টের বিচারক জয়েশ এল চৌতিয়া। আদালত তাকে ১০ দিনের জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। গত কয়েক মাসে গুজরাটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত এক ভুয়া উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে কর্মরত এক ভুয়া অফিসার, ভুয়া সরকারি অফিস, নকল টোল বুথ এবং নকল পুলিশ অফিসার ধরা পড়েছে। এবার প্রকাশ্যে এসেছে এই ভুয়া বিচারকের এক নকল সালিশ আদালত পরিচালনার ঘটনা, যা সকলকে হতভম্ভ করেছে।

পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত ওই ভুয়া বিচারক দাবি করেন- তিনি আইনে পিএইচডি করেছেন। আহমেদাবাদ, ভদোদরা ও গান্ধীনগরে জমি বিবাদে সালিশি পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন বলে দাবি করেছেন। আহমেদাবাদ জোন-২ এর ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসিপি) শ্রীপাল শেশমা বলেন, ‘মরিস ক্রিশ্চিয়ান আদতে সবরমতীর বাসিন্দা। কয়েক বছর আগে গান্ধীনগরে ভুয়া আদালত খুলেছিলেন মরিস। পুলিশে অভিযোগের জেরে সেই আদালতের ঠিকানা বদলে ফেলতে বাধ্য হন। আদালতের ঠিকানা বদলে দিয়েছিলেন। বর্তমানে গান্ধীনগরের সেক্টর ২৪-এ একটা ভুয়া আদালত চালাচ্ছিলেন তিনি।’ পুলিশ জানিয়েছে, সিটি সিভিল কোর্টে মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান স্বীকার করেছেন যে তিনি গত এক বছরে গান্ধীনগর, আহমেদাবাদ এবং ভদোদরায় মিলিয়ে ৫০০টা বিতর্কিত জমি সংক্রান্ত মামলার রায় দিয়েছেন।

প্রতিবেশীরা যা বলছেন

এক সময় মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ানের প্রতিবেশী ছিলেন স্যামুয়েল ফার্নান্ডেজ। তিনি আহমেদাবাদের সবরমতীর কবীর চক এলাকার বহুদিনের বাসিন্দা। তিনি বলেন, ছেলেবেলা থেকেই অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখত মরিস। লোকজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিত। মরিসের মা গোয়ার বাসিন্দা ছিলেন আর বাবা রাজস্থানের।  তিরি আরও বলেন, অনেকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল মরিস কখনও ফেরত দেয়নি। এই অভ্যাসের কারণে সবরমতীর সকলেই ওর থেকে দূরে থাকতে শুরু করে। এক সময় এই এলাকা ছেড়ে চলে যায় মরিসের পরিবার। তার কয়েক বছর পরে যখন আমাদের দেখা হয়েছিল, তখন মরিস জানিয়েছিল ও বিদেশে পড়াশোনা করেছেন এবং বিচারক হয়েছে। তিনি গাড়িতে ভ্রমণ করতেন। এমনকি তার ব্যাগ ধরে রাখার জন্য একজন ব্যক্তি ছিলেন।

যেভাবে ভুয়া আদালত চালনা করতেন?

মামলা পরিচালয়না ২০১৫ সালে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ শুরু করে ভারত সরকার। কারণ ছিল আদালতে দায়ের হওয়া বিপুল সংখ্যক মামলার বোঝা। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সম্মতিতে মামলা নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতাকারী ও আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। এই সময়েই মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান সালিশির প্রশংসাপত্র পান। এরপরই প্রথমে গান্ধীনগরের সেক্টর-২১-এ তার ভুয়ো আদালত শুরু করেন। আদালত পরিচালনার জন্য বিচারকের আসনের ব্যবস্থা করেন। আদালতে একজন বিচারককে যেমন আসনে দেখা যায় তেমনই একটা চেয়ার কেনেন তিনি। এরপর দু’জন টাইপিস্টকে নিয়োগ করেন, জামিনদার নিয়োগ করেন এবং বিতর্কিত জমি ও ভবন সংক্রান্ত মামলার বিচার শুরু করে দেন।

এ বিষয়ে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের আইন বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট দীপক ভাট বলেন, ‘বিচার প্রক্রিয়ার বিপুল বোঝা কমাতে সালিশ এবং দুই পক্ষের সমঝোতার জন্য আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। আরবিট্রাল আইনের ৭ ও ৮৯ ধারা অনুযায়ী এই নিয়োগ করা যেতে পারে।’ মধ্যস্থতাকারী কীভাবে কাজ করেন সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মধ্যস্থতাকারীর কাজ হলো সমঝোতায় আসা যায় এমন মামলায় দুই পক্ষকে লিখিত চুক্তির জন্য রাজি করানো। এই লিখিত চুক্তি তখনই বৈধ হবে যখন দুই পক্ষই অনুমোদন জানাবে এবং স্বাক্ষর করবে।’ দীপক ভট বলেন, ‘আদালতের মতো আদেশ দেয়ার ক্ষমতা সালিশের নেই। আদালত দ্বারা অনুমোদিত হলে তবেই মধ্যস্থতার মাধ্যমে আসা চুক্তি বৈধ হবে।’

যেভাবে প্রকাশ্যে এল সত্য?

ডিসিপি শ্রীপাল শেশমা বলেছেন, ‘সেক্টর ২১ এ ভুয়া আদালত চালানোর সময় মরিসের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। অভিযোগের পর মরিস রাতারাতি ২১ নম্বর সেক্টরের অফিস খালি করে ২৪ নম্বর সেক্টরে একটা আদালত শুরু করে দেন।’ তবে তার বিরুদ্ধে এটাই প্রথম অভিযোগ নয়। ইতিমধ্যেই এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশে একাধিক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আহমেদাবাদ ক্রাইম ব্রাঞ্চ, মণিনগর ও চাঁদখেদায় মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে প্রথমে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিল গুজরাট বার কাউন্সিল। গুজরাট বার কাউন্সিলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও আইনজীবী অনিল কেলা বলেন, ‘আমরা তার ডিগ্রির বিষয়ে জানতে ছেয়েছিলাম। সেই সময় তখন তিনি বলেছিলেন বিদেশে পড়াশোনা করেছেন এবং তার কাছে এমন ডিগ্রি রয়েছে যে দেশের প্রতিটা ক্ষেত্রে তিনি আইনজীবী হিসাবে প্র্যাকটিস করতে পারবেন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম সন্দেহ ছিল এই কথা ভেবে যে এত উঁচু ডিগ্রিধারী একজন ব্যক্তির সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করা উচিৎ। তিনি কেন নিম্ন আদালতে কেন প্র্যাকটিস করবেন?’ এরপর তার ডিগ্রি সংক্রান্ত নথি খতিয়ে দেখা হয়। বার কাউন্সিল যখন তার ডিগ্রি ইত্যাদির বিষয়ে খতিয়ে দেখে তখন জানা যায় সেগুলো সবই জাল। এর ভিত্তিতেই তিনি চার্টারের (দলিল বা সনদ) জন্য আবেদন করেছিলেন। এমনকি ওকালতি করার জন্যও তার প্রয়োজনীয় নথি ছিল না। তাই আমরা ২০০৭ সালে ক্রাইম ব্রাঞ্চে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করি।’

সূত্র: বিবিসি