প্রচ্ছদ জাতীয় বিচারের আশায় ট্রাইব্যুনালে হাত-পা-চোখ হারানো শিবির কর্মীরা

বিচারের আশায় ট্রাইব্যুনালে হাত-পা-চোখ হারানো শিবির কর্মীরা

২০১৭ সালের ১৪ জুন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার উত্তর পাদুয়ার নিজ বাড়ি থেকে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়া হয় সাইফুল ইসলাম তারেককে। তার অপরাধ ছিল তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের স্থানীয় থানার কর্মী। গাড়িতে উঠিয়ে চোখ বেঁধে তাকে পতেঙ্গা র‌্যাব-৭ অফিসে নেওয়া হয়। তিন বছর পর ২০২০ সালের ২০ জুন তাকে ফুলবাড়িয়া থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ ১০ মাস কারাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্তি পান।

রোববার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে গুমের শিকার ছাত্রশিবিরের সাবেক এ কর্মী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগ দায়ের করার পর গুম জীবনের ভয়াবহতার কথা গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন।

সাইফুল ইসলাম তারেক বলেন, সবসময় চোখ বাঁধা থাকত। র‌্যাব সদর দপ্তরের আশপাশে রাখা হয়েছিল একটা সময়। ২৪ ঘণ্টা হাত বাঁধা। কথা বলার মতো অবস্থাও ছিল না। প্রচণ্ড নির্যাতন চালানো হয়েছে। প্রস্রাব করার সময় দিত না। যে বোতলে পানি খেতাম সেই বোতলেই প্রস্রাব করতে হতো। সাড়ে তিন বছর পর মুক্তির পেয়ে আমি ভয়ে কথা বলতে পারতাম না।

তারেক বলেন, প্রথমে আমাকে বান্দরবানের ক্যাসিংঘাটা নিয়ে যায়। পরে সেখানে আগে থেকে গুম করা জয়নাল আবেদীনসহ আমাকে নেওয়া হয় পতেঙ্গা র‌্যাব-৭ ক্যাম্পে। যেখানে ৫৯ দিন একটি কবরের মতো কক্ষে বন্দি রাখা হয়। এর মধ্যে ৩৯ দিন গোসলের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে ৫৯ দিন পর চোখ বেঁধে অন্যত্র কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মম নির্যাতন চালানো হয় প্রতিনিয়ত। খেতে পারলেও মারধর করা হতো, খেতে না পারলেও মারধর করা হতো।

তারেক আরও বলেন, ২০১৯ সালে হঠাৎ জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে দেখা হয় এবং তিনি আমাকে জানান এটা র‌্যাবের উত্তরা ক্যাম্প। সেখান থেকে জয়নাল আবেদীনকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০২০ সালের ২০ জুন গুম জীবন থেকে মুক্তি মেলে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠানো হয়। দীর্ঘ ১০ মাস কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পাই।

সাইফুল ইসলাম তারেকের মতো ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের শাসনামলে র‌্যাব ও পুলিশের নির্যাতনে সারা জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যাওয়া ছাত্রশিবিরের মোট সাত নেতাকর্মী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।

তারা হলেন- পা হারানো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের কর্মী মো. জনি ইসলাম, চট্টগ্রাম বাঁশখালীর ছাত্রশিবিরের কর্মী মো. আব্দুল করিম, পঙ্গু হয়ে যাওয়া বগুড়া শেরপুরের শিবিরের সাবেক কর্মী আলমগীর হোসেন, নির্যাতনে চোখ হারানো নোয়াখালীর দেলোয়ার হোসেন মিশু, গুলশান ভাটারা থানা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি নুরুল আমিন এবং ঝিনাইদহের রতনহাট উপজেলার একটি ইউনিয়নের ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মো. কামারুজ্জামান। এখনো একজন নিখোঁজ রয়েছেন। তার পক্ষে ভাই লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।

গুমের শিকার ভাটারা থানা শিবিরের সভাপতি নুরুল আমিন বলেন, ২০১৩ সালের ২৬ জুন গুলশান আজাদ মসজিদ এলাকা থেকে আমি গুমের শিকার হই। রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসে গুমের শিকার হন রাবি শাখা শিবিরের দুই নেতা। ওই বিষয়ে গুলশান থানায় অভিযোগ করে ফেরার পথে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় আমাকে। প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের আইন সম্পাদক আ. সালাম ভাইকে এবং পরে আমাকে ধরে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেয় এবং চোখ বেঁধে ফেলা হয়।

এক ঘণ্টা পথ চলার পর চারতলা একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রাখা হয়। সেখানে নিয়মিত নির্যাতন করা হয়। বিমানের শব্দে বুঝেছিলাম এটা বিমানবন্দরের আশপাশে হবে। ৩ মাস ১৫ দিন পর হঠাৎ একদিন রাতে চোখ বাঁধা অবস্থায় মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ঘিওর নামক স্থানে ফেলে রেখে যায় এবং আব্দুস সালামকে সাভারের ফেলে রেখে চলে যায়।

আরেক ভুক্তভোগী হলেন বগুড়ার শেরপুরের শিবির নেতা আলমগীর হোসেন। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের প্রতিবাদে মির্জাপুর বাজারে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেছিল শিবির। সেখানে পুলিশ, বিজিবি এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা ও গুলি চালায়। একটি বুলেট এসে তার ডান কানে এসে লাগে। তিনি আহত অবস্থায় পড়ে গেলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে গাড়িতে ওঠানোর সময় ছিনিয়ে নিয়ে হকিস্টিক, লাঠি এবং আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আঘাত করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সেখানে পুলিশ এবং বিজিবি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল।

একপর্যায়ে তাদের হাতে থাকা রামদা দিয়ে দুপায়ে কোপ দেয় এবং মাথায় হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। মৃত ভেবে ৩০ ফুট উঁচু ব্রিজ থেকে ফেলে দিলে তার মেরুদন্ড ভেঙে যায়। যখনই তার জ্ঞান ফেরে তখন তিনি স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এখনো চিকিৎসা চলছে। কিন্তু পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে আলমগীরকে।

তিনি বলেন, আমি মাস্টার্সের ফাস্ট সেমিস্টারে ছিলাম। এ অবস্থার মধ্যে আর আমি পরীক্ষা দিতে পারিনি। দুই বছর পর আমি চেষ্টা করেছি পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। এখন হুইল চেয়ার নিত্যদিনের সঙ্গী। আমার একটাই অপরাধ শিবির করতাম। যারা আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে, নির্যাতন-জুলুম করেছে, ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিয়েছে আমি তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।

চট্টগ্রাম বাঁশখালীর আব্দুল করিম ছিলেন শিবিরের কর্মী। সেটাই যেন তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৩ সালে ৩ মার্চ শান্তিপূর্ণ একটি বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেই মিছিলে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আকস্মিকভাবে হামলা ও গুলি চালায়। একপর্যায়ে একটি বুলেট এসে তার মেরুদণ্ডে লাগে। প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর ডাক্তার তাকে চট্টগ্রাম সদর হাসপাতালে দ্রুত নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের বাধার কারণে স্থলপথে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় ট্রলারযোগে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা অপারগতা প্রকাশ করেন। জানান, তার মেরুদণ্ড অকার্যকর। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। ১১ বছর ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেই হাসপাতালে। সেটাই যেন এখন তার স্থায়ী নিবাস।

আব্দুল করিম বলেন, জীবনটা এমন হয়ে যাবে কখনো ভাবিনি। আজ আমি প্যারালাইজড। কোমর থেকে নিচে কোনো বোধশক্তি নেই। হুইলচেয়ারে চলতে হচ্ছে। যাদের কারণে আজ আমার এই অবস্থা আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

২০১৭ সালের ৫ মে রাতে ঝিনাইদহ শহর থেকে গুম করা হয় ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন রতনহাট উপজেলার একটি ইউনিয়নের সভাপতি কামারুজ্জামানকে। জোরপূর্বক কামারুজ্জামানকে উঠিয়ে নেওয়ার সময় সবাই প্রশাসনের লোক বলে পরিচয় দেয়। পরে ৭ বছরেও তার কোনো খোঁজ মেলেনি।

ভুক্তভোগীদের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করার পর ইসলামী ছাত্রশিবিরের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আল নোমান সাংবাদিকদের বলেন, কেউ পঙ্গু হয়েছেন, কারো অঙ্গহানি হয়েছে। দুজন গুম হওয়ার দীর্ঘসময় পর ফিরে এসেছেন। আরেকজন এখনো ফেরেননি। তাকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব লোক এই মানবতাবিরোধী কাজে জড়িত ছিলেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান ভুক্তভোগীরা।

পৃথক সাত অভিযোগে আলাদাভাবে মোট ৫৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীসহ তৎকালীন কর্তব্যরত র‌্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারা।