ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেদিন দুপুরে তার পালিয়ে যাওয়ার খবর চাউর হলে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার রাজপথে। তখন ছাত্র-জনতা দলে দলে আনন্দ মিছিল করে। এই সুযোগে হাসিনার অনুসারী ও প্রশাসনের বিতর্কিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে যার মতো করে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেদিনের পর থেকে নানাজনের পালানোর খবর বের হলেও তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান কীভাবে পালিয়েছিলেন সেটা তেমন আলোচনায় আসেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেদিন দুপুর দুইটার দিকে অ্যাম্বুলেন্স যোগে ওবায়দুল হাসান তার হেয়ার রোডে থাকা বাসা থেকে পালিয়ে যান। এরপর আশ্রয় নেন এমপিদের একটি ভবনে। পরে বিকেলে সেখান থেকে তাকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বের করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যান।
ওবায়দুল হাসানের বাসায় গত কয়েক বছর ধরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, দুপুরে প্রধান বিচারপতি বাসায় ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বিভিন্ন স্থানে মিছিল ও হামলার খবর টেলিভিশনে দেখতে পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তিনি। এক পর্যায়ে তিনি বাসা থেকে চলে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কীভাবে যাবেন তা বুঝতে পারছিলেন না। শেষে তার বাসায় আগে থেকে থাকা অ্যাম্বুলেন্সে চেপে বসেন এবং চালককে দ্রুত তাকে অন্যত্র নিয়ে যেতে বলেন। তবে তার গন্তব্য হেয়ার রোডের মধ্যেই ছিল বলে জানান নিরাপত্তা কর্মীরা।
সাবেক প্রধান বিচারপতির আতঙ্কিত হওয়ার কারণও ছিল। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন গত জুলাই মাসের শুরুতে যখন রাজপথে গড়ায় তখন আদালতে শুনানিতে তিনি উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন- ‘আদালতের বিষয় নিয়ে রাজপথে কীসের আন্দোলন!’ তার এই বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছিল ছাত্র-জনতা। তাছাড়া তিনি নেত্রকোনার একটি চিহ্নিত আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। নিজেও এক সময় ছাত্রলীগ করেছেন।
ওবায়দুল হাসানের ভাই সাবেক আমলা সাজ্জাদুল হাসান সদ্য বিদায়ী সংসদের সদস্য ছিলেন। তার বাবা ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠভাজন। ওবায়দুল হাসান প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর ছাত্রলীগ তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তখন বিভিন্ন মহল থেকে প্রধান বিচারপতির এমন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা হয়। এসব কারণে তিনি ভয়ে ছিলেন, ছাত্র-জনতা তার বাসায় হামলা করতে পারে। তার আশঙ্কা সত্যও প্রমাণিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তার বাসায় হামলাও হয়েছিল। যদিও তিনি বাসা থেকে পালিয়ে সেদিনের মতো রক্ষা পান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওবায়দুল হাসানের বাসায় দায়িত্ব পালন করা একজন কর্মী সে দিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘স্যার দুপুর ঠিক দুইটার দিকে বাসা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে চলে গেছেন। ওই সময় এক নিরাপত্তা কর্মী অ্যাম্বুলেন্সটি গেটে আটকে দেন। তিনি জানতে চান গাড়িতে কে যাচ্ছেন। পরে তার গানম্যান সেই পুলিশ সদস্যকে জানান, স্যার আছেন। তখন তিনি গাড়িটি বের হওয়ার অনুমতি দেন। এরপর অ্যাম্বুলেন্সটি স্যারকে নিয়ে বের হয়ে যায়।’
ওই বাসার আরেকজন বলেন, ‘সেদিন প্রধান বিচারপতি বের হওয়ার পর তার বাসায় আরও তিনজন বিচারপতি ছিলেন। পরে তারাও বের হয়ে যান। তিনজনই পাশে মিন্টো রোডে একটি ফ্ল্যাটে আশ্রয় নেন। সেখানে আগে থেকেই প্রধান বিচারপতির জন্য একটি ফ্ল্যাট ছিল। এরপর বিকেলে শুনেছি তাদের বের করে নিয়ে গেছেন সাদা পোশাকের কয়েকজন গোয়েন্দা।’
জানা গেছে, তৎকালীন প্রধান বিচারপতির বাসায় ওই দিন তার স্ত্রী-সন্তান আত্মীয়-স্বজন কেউ ছিলেন না। প্রধান বিচারপতি বের হয়ে যাওয়ার পর যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন তারা তটস্থ হয়ে পড়েন। কী ঘটে, কারা কখন হামলা করে বসে সেটা নিয়ে তারা ছিলেন আতঙ্কিত। এরপর সেখানে সেদিনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা তাদের ডিউটি পোশাক খুলে ফেলেন। তারা লুঙ্গি ও টি-শার্ট পরে সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশ ধারণ করেন এবং ছাত্র-জনতার মাঝে মিশে যান।
প্রধান বিচারপতির বাসায় দায়িত্ব পালন করা একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতি দুপুর দুইটার দিকে বের হয়ে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর সেখানে হাজির হন ছাত্র-জনতা। তারা বিচারপতিকে খুঁজতে থাকেন। এসময় উপস্থিত ছদ্মবেশে থাকা নিরাপত্তা কর্মী ও বাসাটির লোকজন বলেন, তিনি চলে গেছেন। এরপরও বিক্ষুব্ধ জনতা বাসাটির ভেতর ঢুকে পড়ে এবং বিভিন্ন জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। তবে ওই সময় প্রধান বিচারপতির বাসায় কিছু লোক অবস্থান করলেও তারা নিরাপদে ছিলেন।
সূত্র : ঢাকা মেইল