
ভূমি মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নাধীন ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের আওতায় থাকা স্মার্ট ভূমি সেবা ২৬ নভেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে। চলতি মাসের ১ তারিখে চালু হওয়ার কথা থাকলেও তা আজও চালু হয়নি।
এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে ভূমির সেবা গ্রহীতারা। রাজধানীর লালবাগ, ডেমরা, কেরানীগঞ্জ, কোতোয়ালি, গুলশান, তেজগাঁও এবং এর আশপাশের বিভিন্ন ভূমি অফিসে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। সেবা না পেয়ে আক্ষেপ জানিয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ভুক্তভোগীরা।
সরেজমিনে রাজধানীর তেজগাঁও ভূমি অফিসে গিয়ে কথা হয় সেবা নিতে আসা নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা কমান্ডার আজিমুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তার সিঙ্গাপুর যাওয়া জরুরি। তাই বনশ্রীতে থাকা ১১ কাঠা জায়গা বিক্রির জন্য খাজনা দিতে এসে জানতে পারেন স্মার্ট ভূমি সেবা বন্ধ রয়েছে।
এ জন্য জমি দলিল করা সম্ভব হচ্ছে না। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন নৌবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তা।
আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে আমরা খাজনা দেওয়ার চেষ্টা করছি। কবে নাগাদ এই সেবা চালু হবে তা-ও জানি না।
প্রতিদিনই ভূমি অফিসে এসে ফেরত যাই। জমি রেজিস্ট্রি করা যাচ্ছে না। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য টাকা প্রয়োজন, আমার জমির ক্রেতাও প্রস্তুত, কিন্তু রেজিস্ট্রি করে দিতে পারছি না। অনলাইন সেবা বন্ধ করার আগে অবশ্যই ম্যানুয়াল প্রক্রিয়া চালু করা উচিত ছিল।’
এর আগে ২৪ নভেম্বর বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তিতে ভূমি মন্ত্রণালয় জানায়, ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে গত ১ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত মিউটেশন, ভূমি উন্নয়ন কর এবং ই-পরচার অনলাইন সেবা বন্ধ থাকবে। কিন্তু গতকাল সরেজমিনে গিয়েও এই সেবা বন্ধ রয়েছে বলে জানা যায়।
গতকাল বুধবার সকাল সোয়া ১০টায় তেজগাঁও ভূমি অফিসে দেখা যায়, স্মার্ট সেবা বন্ধ রয়েছে, তা না জেনেই দলিল করতে এসেছে অনেকে। এর মধ্যে যাদের সর্বশেষ বছরের খাজনা দেওয়া নেই, তারা দলিল করতে পারছে না। ম্যানুয়ালি খাজনা দিতে চাইলেও নেওয়া হচ্ছে না ভূমি অফিসগুলোতে। দুপুর ১টা পর্যন্ত বেশ কিছু সেবাগ্রহীতা ভূমি অফিসে এসে সেবা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফেরত যেতে বাধ্য হয়।
সেখানে কথা হয় মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘২৮ নভেম্বর জমি রেজিস্ট্রি নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ভূমি অফিসে গিয়ে জানতে পারি খাজনা নেওয়া বন্ধ রয়েছে। ফলে জমি রেজিস্ট্রি নিতে পারছি না। এর মধ্যে জমি মালিকের সঙ্গে বড় অঙ্কের টাকার লেনদেনও সম্পন্ন হয়েছে।’
এদিকে রাজধানীর লালবাগে অবস্থিত ভূমি অফিসে এসে অনলাইনভিত্তিক ভূমিসেবা না পেয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে দেখা গেছে বেশ কিছু সেবাগ্রহীতাকে। দলিল লেখক অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নামজারি ও খাজনা না দিতে পেরে মানুষ দলিল করতে পারছে না।
কেরানীগঞ্জের কলমার চর থেকে শফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি আমার কাছে এসেছেন জমি দলিলে সহায়তার জন্য। তিনি এই জমি বিক্রি করে কিডনির চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন। প্রায় ১৬ দিন হলো তার কাজ বন্ধ। এত দীর্ঘ সময় ধরে নামজারি খাজনা গ্রহণ বন্ধ রাখা সবার জন্য রীতিমতো ভোগান্তি তৈরি করেছে।’
নবাবগঞ্জের বাসিন্দা আমেনা বেগম ৬ শতাংশ জায়াগা বিক্রির জন্য দলিল করতে এসেছেন লালবাগ ভূমি অফিসে। তিনিও একই ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন। ভূমিকর প্রদান করতে না পেরে আটকে গেছে তার দলিল। কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর ভূমি অফিসে গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। সেখানেও রফিকুল নামের এক ব্যক্তি এসেছেন জমির দলিল করতে।
তিনি তার ভাইদের মধ্যে বণ্টননামার দলিল করবেন বলে জানা যায়। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের সম্পত্তি বণ্টননামার দলিল করতে না পারলে নিজেরা বিক্রি করতে পারছি না। অফিসে এসে জানলাম এই সেবা বন্ধ আছে। কবে তা খুলবে সেটাও জানি না।’
কেরানীগঞ্জের কোণ্ডা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গিয়েও পাওয়া যায় একই চিত্র। হেবা দলিল করতে এসে ৭৫ বছরের বৃদ্ধা শাহিনুর বেগমের ছেলে রবিউল ও আব্দুল করিম আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার মাকে নিয়ে ওমরাহ হজে যাওয়ার জন্য টাকা জমা দেব। কিন্তু হেবা দলিল হচ্ছে না বিধায় আটকে আছে। হঠাৎ করে এ ধরনের সেবা বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছি আমরা।’
নামজারি করতে এসে বিপাকে পড়েছেন আরেক ভুক্তভোগী বদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘কম্পিউটার দোকানে নামজারির আবেদন করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা বলেছে আবেদন আপাতত বন্ধ রয়েছে। তাই রাজস্ব সার্কেলে এসেছি। কিন্তু তারাও বলছেন অনলাইন আবেদন বন্ধ থাকায় নামজারি হচ্ছে না।’
ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে কম্পিউটার দোকানের কর্মচারী কৃষ্ণ বলেন, গত মাসের ২৬ তারিখ থেকে ভূমি অফিসের সার্ভার বন্ধ। তাই ভূমি উন্নয়ন কর, স্মার্ট নামজারি, পরচা ও জমির ম্যাপ উত্তোলন সেবা পাওয়া যাচ্ছে না।
কোতোয়ালি রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মেহেরুন্নাহার বলেন, ‘স্মার্ট ভূমি সেবা সফটওয়্যার আপগ্রেডেশন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তাই গ্রাহকরা সমস্যায় পড়েছেন। অতিদ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সহকারী কমিশনার বলেন, স্মার্ট ভূমি সেবা বন্ধ থাকায় সেবা প্রার্থীরা প্রতিদিনই ফিরে যাচ্ছে। সরকারি নির্দেশনা না থাকায় ম্যানুয়ালিও নামজারিসহ অন্যান্য সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। মূলত সফটওয়্যার আপগ্রেডেশনের কারণে এমনটি হচ্ছে। ভূমি অফিসের দেওয়া আইডি-পাসওয়ার্ড দিয়েও লগ ইন করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে ভূমি সংস্কার বোর্ড কর্মকর্তা সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘গত মাসের ২৬ তারিখ থেকে অনলাইনভিত্তিক এই ধরনের সেবা বন্ধ আছে।’