প্রচ্ছদ জাতীয় আমার ছেলে তো শহীদ, তাই তাকে গোসল ছাড়াই দাফন করেছি

আমার ছেলে তো শহীদ, তাই তাকে গোসল ছাড়াই দাফন করেছি

জাতীয়:বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের (২৪) বাবা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মো: মহিউদ্দিন বলেছেন, ‘আমার ছেলে তো শহীদ, তাই আমি তাকে গোসল ছাড়াই দাফন করেছি।’

বুধবার ইয়ামিনের বাবা এ কথা বলেন। গত ১৮ জুলাই সাভারসহ দেশ যখন উত্তাল, ঠিক ওই সময় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা, বাসসট্যান্ড, রেডিও কলোনি এলাকা হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে সাভারের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে যেতে চায়। বেলা তখন ১১টা, পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকার দলীয় অঙ্গ-সংগঠনের কর্মীরা পিস্তল, লাঠি, হকস্টিক ও দেশীয় অস্ত্র হাতে মহাসড়কে আন্দোলনবিরোধী স্লোগান দেয়। এতে শুরু হয় আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া। সেখানের সংঘর্ষে শতাধিক গুলিবিদ্ধসহ বিভিন্নভাবে আহত হয়।

বেলা দেড়টার দিকে ইয়ামিন জোহরের নামাজ জামায়াতে আদায় করে খবর পান যে তার এক শিক্ষিকার ছেলে চোখে রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়ে আহত হয়। তখন ইয়ামিন আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং শিক্ষিকার ছেলের খোঁজ নিতে পাকিজা এলাকার মডেল মসজিদ এলাকায় পৌঁছে পুলিশ সাঁজোয়া যানের ভেতর থেকে যেন গুলি ছুড়তে না পারেন সে জন্য তার দরজা বন্ধ করে দেন। তখন পুলিশ তার পাজরের বাম পাশে খুবই কাছ থেকে গুলি করলে এবং গুরুতর আহত হন ইয়ামিন। ওই সময় মুমূর্ষু অবস্থায় পুলিশের সাঁজোয়া যানে করে ঘুরানো হয় তাকে।

এক পর্যায়ে মৃত ভেবে টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দেয়া হয় সাঁজোয়া যান থেকে। সেই দৃশ্য ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী, থাকতেন এমআইএসটির ওসমানী হলের ৬১৯ নম্বর কক্ষে। বাসা সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায়।

ইয়ামিনের বাবা মো: মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমি আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য প্রশাসনের কারো কাছেই কোনো বিচার চাই না। কার কাছে বিচার চাইব, যে পুলিশ আমার ছেলেকে হত্যা করেছে, তারা কি করবে আমার ছেলের হত্যার বিচার!’

তিনি বলেন, ‘ছেলের মৃত্যুর পর তাকে দাফন করতে গিয়েও আমাকে পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনায়। প্রথমে কুষ্টিয়ায় আমার গ্রামের বাড়িতে দাফন করানোর উদ্দেশে রওনা দিলে আমার আত্মীয়রা জানায় যে স্থানীয় থানা পুলিশ তাদের বলেছেন, তাদের অনুমতি ছাড়া সেখানে কাউকে দাফন করা যাবে না। পরে সাভারের তালবাগে ইয়ামিনের নানা-নানির কবরের পাশে দাফন করতে চাইলে সেই গোরস্তানের কর্তৃপক্ষ জানায়, ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফন করতে গেলে পুলিশি ঝামেলা হবে। পরে বাধ্য হয়ে ব্যাংক টাউনের এই গোরস্তানে আমার ছেলেকে দাফন করি।’

মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলের হত্যার পুরো দৃশ্যটি আপনারা সবাই দেখেছেন। একজন গুলিবিদ্ধ জীবিত মানুষকে কি কেউ এমনভাবে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় ফেলতে পারে? তখনো যদি আমার ছেলেকে হাসপাতালে নেয়া হতো, হয়তো প্রাণে বেঁচে যেত। কিন্তু আমার মুমূর্ষু ছেলেকে চিকিৎসার সুযোগটিও দেয়নি তারা। আমার ছেলে এবং আমার পুরো পরিবার কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না। আমার ছেলে রাজনীতিকে পছন্দ করত না। আমার শ্বশুর একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেই হিসেবে আমার ছেলেও একজন মুক্তিযোদ্ধার নাতি, কোটা সুবিধা ভোগ করতে পারত। কিন্তু সেও চেয়েছে ছাত্রদের মধ্যে কোনো বৈষম্য না থাকুক। সে তার আহত বন্ধুদের নিয়ে খুব চিন্তিত এবং বিমর্ষ থাকত। আর সে জন্যই ইয়ামিন সেদিন তার আহত বন্ধুদের বিচারের দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। এই দেশের সরকারের যদি দয়া হয়, তবে একদিন আমার ছেলে হত্যার বিচার করবে।’

ইয়ামিনের জন্ম ২০০১ সালের ১২ ডিসেম্বর। তিনি সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। মা নাসরিন সুলতানা গৃহিণী, বোন শাইখ আশহাবুল জান্নাত পড়ছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সূত্র : নয়াদিগন্ত