প্রচ্ছদ জাতীয় দুদকের গোড়াতেই গলদ-অস্বচ্ছতা

দুদকের গোড়াতেই গলদ-অস্বচ্ছতা

দেশে দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতি দমন আইন অনুযায়ী, এটি একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বশাসিত সংস্থা। নিয়মানুযায়ী দুদকের শীর্ষ তিন কর্মকর্তা নিয়োগে গঠিত হয় বাছাই কমিটি। প্রতিটি পদের বিপরীতে দুজন করে ছয়জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করে কমিটি। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি তিনজনকে সংস্থাটির শীর্ষ পদে নিয়োগ দেন। তবে সার্চ কমিটি ছয়জন কীভাবে নির্বাচন করবে, সুনির্দিষ্টভাবে সেই প্রক্রিয়া বা বিধিমালা নেই। এ ছাড়া সংবিধানের ৪৮(৩) ধারার বাধ্যবাধকতায় রাষ্ট্রপতি আবার প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজ করতে পারেন না। ফলে খাতা-কলমে দুদকে কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ দেখানো হলেও আদতে সরকারের ইচ্ছার বাইরে দুদকের শীর্ষ তিন পদে নিয়োগ এক প্রকার অসম্ভব। যে কারণে প্রতিষ্ঠার পর থেকে যারাই দুদকের দায়িত্বে এসেছেন, তাদের বিরুদ্ধেই ক্ষমতাবানদের দুর্নীতিকে দায়মুক্তি দেওয়া এবং বিরেধী মত দমনে মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রচণ্ড ক্ষমতাবান এই কমিশন সৃষ্টির পর থেকেই ক্ষমতাবান বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বড় বড় দুর্নীতিবাজের ‘রক্ষাকবচ’ হিসেবে কাজ করেছে।

সরকারের ফরমায়েশে বিরোধী মত দমনে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিরও অভিযোগ অসংখ্য। ফলে দিনে দিনে জনমনে দুদকের গ্রহণযোগ্যতা একদম তলানিতে নেমে এসেছে। গত ১৫ বছরে দুদকের সবচেয়ে ভঙ্গুর দুর্দশা দেখা গেছে। এই সময়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে সাধারণ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানের চাল চুরির অভিযোগ অনুসন্ধানেও অনীহা ছিল সংস্থাটির শীর্ষ কর্তাদের। এ ছাড়া সরকার বিব্রত হয় বা হতে পারে এমন কাজ করতে নারাজ ছিল কমিশন। জুনিয়র অফিসাররা তৎপরতা দেখালেও তদন্তের অনুমতি মেলেনি। এ ছাড়া বড় বড় দুর্নীতিবাজকে আটকাতে এবং দুর্নীতি বন্ধে সংস্থাটি ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আইনের মারপ্যাঁচে সরকারি ক্ষমতাবানদের অভিযোগ তদন্তে অনীহা থাকলেও তৎপর ছিল বিরোধী মত দমনে। সরকার-ঘনিষ্ঠদের দায়মুক্তি দিলেও এই সময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও ড. ইউনূসের মতো সম্মানিত ব্যক্তিদেরও মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ সংস্থাটির বিরুদ্ধে। আবার ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর কোনো ধরনের নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে সেসব মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির এমন কার্যক্রমে বিভিন্ন মহলে হচ্ছে হাসি-ঠাট্টা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদককে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হলে কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে হবে। দল ও মতের ঊর্ধ্বে যোগ্য, দক্ষ ও সাহসী কর্মকর্তাদের কমিশনে নিয়োগ দিতে হবে। দক্ষ, যোগ্য, সাহসী ও নিরপেক্ষ কমিশন ছাড়া দুদককে শক্তিশালী করার আর কোনো পথ নেই।

নথিপত্র বলছে, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ৭নং ধারায় বাছাই কমিটি গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে। ৭নং ধারার বিভিন্ন উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ প্রদানের উদ্দেশ্যে পাঁচ সদস্যের সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি গঠন হবে। প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক কমিটির প্রধান বা সভাপতি হবেন। প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এবং অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবদের মধ্যে সবশেষে অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব কমিটির সদস্য হবেন। তবে শর্ত, যদি উক্তরূপ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি বাছাই কমিটির সদস্য পদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহলে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবের অব্যাহিত পূর্বের অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব সদস্য হবেন। আর যদি তাকেও না পাওয়া যায়, তাহলে বর্তমানে কর্মরত মন্ত্রিপরিষদ সচিব সদস্য হবেন। বাছাই কমিটিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কার্যসম্পাদনে প্রয়োজনীয় সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবে। এরপর বাছাই কমিটি ৩টি পদের বিপরীতে ৬ জনের নাম সুপারিশ করবেন। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি তিনজনকে নিয়োগ দেবেন।’

তবে নথিপত্র ঘেঁটে, বাছাই কমিটি কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় ৬ জনকে নির্বাচিত করবেন, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। বাছাই কমিটি তাদের নির্ধারিত ছয়জনের তালিকাও প্রকাশ করে না। ফলে তারা কাদের নির্ধারণ করেছে, সেটিও কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়।

আবার সংবিধানের প্রথম পরিচ্ছেদের ৪৮(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন: তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কী পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।’

সংবিধানের এই ধারার ক্ষমতাবলে, বাছাই কমিটি যেই নামেই প্রস্তাব করুক না কেন, সেটি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ বা পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি অনুমোদন করতে পারবেন না। আবার বাছাই কমিটি কাদের নাম সুপারিশ করেছে, সেটা যেহেতু কারও পক্ষেই জানা সম্ভব নয়, তাই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেও নাম পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন ও সংবিধানের এই মারপ্যাঁচের কারণে পুরো বিষয়টিতেই অস্পষ্টতা ও অস্বচ্ছতা থেকেই যাচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের প্রতি অনুগত ব্যক্তিরাই রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। ফলে বাছাই কমিটি যাদের নিয়ে গঠন করার কথা বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির সরকারের আজ্ঞাবহ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই বাছাই কমিটিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার পক্ষেও মত সংশ্লিষ্টদের।

জানা গেছে, দুদক আইন তৈরির সময় আইনমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বাছাই কমিটি নির্ধারণের সময় তিনি তখন কমিটিতে অর্থমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীকে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশসহ (টিআইবি) সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা প্রতিবাদ করলে সেটি পরিবর্তন করে দুটি সাংবিধানিক পদ বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যানকে বাছাই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

জানতে চাইলে দুদকের এক মহাপরিচালক (ডিজি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ইতোপূর্বে সার্চ কমিটি থেকে নাম দেওয়া হয়নি, এমন ব্যক্তিরাও দুদকের শীর্ষ পদে এসেছেন বলে শোনা গেছে। ফলে আমি মনে করি, সার্চ কমিটি যাদের সিলেক্ট করবে, তাদের নাম পত্রিকায় বা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে দেওয়া উচিত।’

দুদকের আরও একজন কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘শোনা গেছে আমাদের সর্বশেষ কমিশনের শীর্ষ দুজনের নাম সার্চ কমিটির সুপারিশে ছিল না। আবার সার্চ কমিটির বাছাইয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া বা নীতিমালা নেই।’ এই কর্মকর্তা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘সার্চ কমিটি প্রথমে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কে কে দুদকের শীর্ষ পদে আসতে চান, দুদক নিয়ে তাদের পরিকল্পনা জানতে চেয়ে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। এরপর সেখান থেকে কিছু নির্দিষ্ট মানদণ্ডের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে যোগ্যদের নির্বাচন করে সেখান থেকে ছয়জনকে নির্ধারণ করা যেতে পারে।’

বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সংস্থাটির সাবেক কর্মকর্তারাও। জানতে চাইলে দুদকের সাবেক কমিশনার (তদন্ত) এ এফ এম আমিনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘সার্চ কমিটি যাদের নাম সিলেক্ট করবে তাদের নাম প্রকাশ করে দেওয়া উচিত, যাতে স্বচ্ছতা থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুদকের প্রধান চেয়ারম্যানসহ তিনজন কর্মকর্তা। সে ক্ষেত্রে দুজন কোনো বিষয়ে একমত হলে বাকি একজনের মতামত তেমন গুরুত্ব বহন করে না। তাই একই সার্ভিস থেকে দুজন নিয়োগ দেওয়া যাবে না।’

এসব বিষয়ে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘বাছাই কমিটি কীভাবে নামগুলো সংগ্রহ করে, সেটার ওপরে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রক্রিয়াটা নির্ধারণ করা উচিত। একসময় ছিল ক্যাবিনেট সেক্রেটারি কয়েকটা নাম দিতেন। সেই নামগুলোই বিবেচনায় আনা হতো।’

দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থায়ই দলীয় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তিকে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমনে দক্ষ, উপযুক্ত, ব্যক্তিজীবনে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, আমলাতান্ত্রিক স্বার্থমুক্ত এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের কমিশনার হিসেবে নিয়োগের আহ্বান জানাই। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিলে নজিরবিহীন ত্যাগের বিনিময়ে সৃষ্ট জনপ্রত্যাশা যেমন আরও একবার ধূলিসাৎ হবে, তেমনই অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে।’

সূত্র : কালবেলা