স্বৈরশাসন ঠেকাতে হলে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী পন্থা হবে আনুপাতিক নির্বাচন। এই পদ্ধতি প্রবর্তন করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। এই পদ্ধতিতে কী সুবিধা- এই পদ্ধতির জন্য সাধারণ জনমত গড়ে তুলতে রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। জানা যায় এই দাবির পক্ষে জামায়াতসহ অধিকাংশ দল একমত হলেও বিএনপি না বলে দিয়েছে।
‘রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধান সংশোধনী’ বিষয়ে এক আলোচনায় বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেছেন। সমাজ গবেষণা কেন্দ্র শনিবার রাতে ভার্চ্যুয়াল ওই আলোচনার আয়োজন করে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, ‘যে সংস্কারই করা হোক না কেন, সবকিছু নির্ভর করে তা সত্যিকারভাবে বাস্তবায়ন করার ওপর। আর তা কার্যকর করবে রাজনৈতিক দল, যারা পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত হবে।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো রওনক জাহান বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব প্রস্তাব এসেছে, বেশির ভাগই কাঠামোগত পরিবর্তন কিংবা কাঠামোর পরিবর্তন। ভাবতে হবে, আমাদের এখানে স্বৈরতন্ত্রের যে উত্থান হয়েছে, সেটি কি কাঠামোর অভাবের কারণে? স্বৈরতন্ত্রের জন্য আমাদের সংবিধান কি দায়ী? নাকি আমাদের লংটার্ম কোনো প্রাকটিস, কিছু নর্মস?… অনেক স্বৈরতান্ত্রিক শাসক মিলিটারি শাসক, তারা তো সংবিধানকে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন।
হত্যা মামলার আসামি বিএনপি নেতা রবির দলীয় পদ স্থগিত
আবার অনেক স্বৈরতান্ত্রিক শাসক আছেন, যাঁরা সংবিধানের কিছু কাঠামোকে রেখে কাঠামোর যে স্পিরিট, সেটাকে তারা নষ্ট করেছিলেন। উদাহরণ হচ্ছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে স্পিরিটটা ছিল, সেটাকে নষ্ট করে দিয়ে তারা তখন সেটাকে দলীয়করণ করার চেষ্টা করেছিলেন। কাঠামো ও নতুন আইনের দিকে যতটা মনোযোগ দিচ্ছি, তার চেয়ে আমাদের বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার গত ৫০ বছরে যেসব অগণতান্ত্রিক প্রাকটিস হয়েছে, নর্ম হয়েছে- এগুলোকে আমরা কী করে পরিবর্তন করতে পারব।… আমরা কাঠামো ও পদ্ধতি পাল্টাচ্ছি কিন্তু আসলে একজন এক ব্যক্তির কাছে সবসময় ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে রয়েছে।’
রওনক জাহান আরও বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে এত কথা বলছি, সেখানে কিন্তু আমাদের রাজনীতির সংস্কার, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার নিয়ে তেমন কথা হচ্ছে না। কিন্তু আসলে যদি আমরা দেশটাকে গণতান্ত্রিক করতে চাই, তাহলে কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র আনতে হবে। তা না হলে আমরা কখনই গণতান্ত্রিক হতে পারব না। শুধু কিছু আরপিও দিয়ে বাধ্যবাধকতা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক করা যাবে না। সে জন্য আমার মনে হয় প্রধান যে দায়িত্ব, সেটা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘…যতগুলো রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছি, সংবিধান সংস্কারের কথা হচ্ছে- এগুলো আসলে পলিটিক্যাল প্রজেক্ট। এই পলিটিক্যাল প্রজেক্ট যদি বাস্তবায়ন করতে চাই, টেকসই করতে চাই, তাহলে কিন্তু এটার জন্য রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক দলগুলোর একটা লংটার্ম কমিটমেন্ট দরকার।’
রওনক জাহান বলেন, ‘আমরা যদি স্বৈরশাসনকে চেক দিতে চাই, তাহলে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী পন্থা হবে আনুপাতিক নির্বাচন। দেশের মানুষ এই পদ্ধতি নিয়ে অতটা ভালো জানে না। এই পদ্ধতিতে সংসদ সদস্যরা এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। অতএব এই পদ্ধতিতে কী সুবিধা, এই পদ্ধতির জন্য সাধারণ জনমত গড়ে তোলার জন্য এখানেও আমার মনে হয় রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করতে হবে। এই পদ্ধতি প্রবর্তনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করতে হবে। যেহেতু স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নে সংসদ সদস্যের ভূমিকা থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘সংস্কার শুধু একটা রিপোর্ট লিখে বা আইন করেই হবে তা নয়। এর বাস্তবায়ন ও টেকসই এবং এ জন্য লংটার্ম যে কমিটমেন্টের দরকার হবে, তার ওপর জোর দিতে চাই। স্টেট অ্যাক্টরদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য করলেই হবে না। যদি রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তাহলে নন স্টেট অ্যাক্টরদের বড় একটা ভূমিকা আছে। তাদের ক্ষমতা, তাদের স্বাধীনতা রাখতে হবে। সেখানে মিডিয়া, বিশেষ করে নাগরিকের কণ্ঠস্বর, সেটি যাতে কখনই রুদ্ধ না হয়, সেটার জন্য একটা ব্যবস্থা নিতে হবে।’
আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। প্রবন্ধে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, সরকারের মেয়াদ হ্রাস (৫ বছর থেকে ৪ বছর), সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণ ও আনুপাতিক নির্বাচনের প্রবর্তনসহ ১১টি রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবের পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। বলা হয়, বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশ আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা অনুসরণ করে। এই নির্বাচনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে ক্রম অধিকারসম্পন্ন প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। এরপর সারা দেশব্যাপী যে রাজনৈতিক দল যত শতাংশ ভোট পায়, সংসদে তত শতাংশ আসন পায়।
১১টি সংস্কারের মধ্যে ৭টি সংস্কারের জন্যই আনুপাতিক নির্বাচন দরকার বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের বহু প্রস্তাব-আলোচনা হতে পারে। কিন্তু আনুপাতিক নির্বাচনটা হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর। এটা করলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে, সেটির দিকে নজর দেওয়া দরকার। রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব প্রস্তাব সাধারণভাবে আলোচিত হচ্ছে, সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়াই তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। নবলিখন ও পুনর্লিখন নিয়ে কথা হচ্ছে, তবে তাদের যুক্তিটা পরিষ্কার নয়।… তার মানে এই নয় যে সংবিধান আদর্শ অবস্থায় আছে।… সংশোধনের ব্যবস্থা শুরু হয় নির্বাহী বিভাগ দিয়ে, রাষ্ট্রপতি দিয়ে যা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সংবিধানে অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা আছে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে।… এটা করতে হলে দীর্ঘ আলোচনার দরকার হবে এবং যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো আছে, তাদের সম্পৃক্ত করে আলোচনা করতে হবে। যে সংস্কারগুলো করা উচিত, তার মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য যদি নির্বাচন সংস্কার করি, আনুপাতিক নির্বাচন প্রবর্তন করতে পারি, তাহলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একসঙ্গে কাজ করার যে অভ্যাসটা, সংস্কৃতিটা এবং বিরোধ সত্ত্বেও গঠনমূলকভাবে সেটি নিরসনের প্রয়াসের একটা প্রক্রিয়ার সূচনা হবে। তাহলে ভবিষ্যতে এই সংবিধানের যে অন্য বড় যে ইস্যু আছে, তা নিরসনের সুযোগ হবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘শুধু কাঠামোগত পরিবর্তন আনলেই হবে না। যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না ঘটে এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে যদি ঐকমত্য সৃষ্টি না হয়, তাহলে এগুলো টেকসই হবে না। আমাদের রাজনীতিবিদরা অতীতে অনেক অঙ্গীকার করেছেন কিন্তু কেউ কথা রাখেননি। রাজনীতিবিদরা যদি কথা না রাখেন, তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি পরিবর্তন না হয় এবং তাদের মধ্যে কতগুলো মৌলিক বিষয়ে যদি ঐকমত্য না হয়, তাহলে আমরা যতই কাঠামোগত সংস্কার করি এগুলো টেকসই হবে না।’ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘মেয়াদ হ্রাস করে চার বছর করার বিষয়ে একমত। প্রোপরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন হলে ৭০ অনুচ্ছেদ থাকা উচিত। জনগণের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করতে হবে। আর্থিক সক্ষমতার ব্যবস্থা না করে হলে এটি ভালো ফল দেবে না। সুতরাং একটি আইন করে দিতে হবে যে জাতীয় বাজেটের ৩০-৪০ শতাংশ বাজেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থানীয় বডিতে (সরকারে) যাবে।’
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সমাজ গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি তাজুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর চেয়ারম্যান এম এম আকাশের সঞ্চালনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য আনু মুহাম্মদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সহকারী সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন আলোচনায় অংশ নেন।
সূুত্রঃ যায়যায়দিন