সারাদেশ: ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন-অর-রশীদের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত মাহমুদুল হাসান ওরফে জুয়েল। চাকরি জীবনে হারুনের সঙ্গে থেকেছেন ছায়ার মতো। যেখানেই হারুন দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই বদলি করে সঙ্গে নেওয়া হয়েছে মাহমুদুলকে। বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি থানায় অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে হারুনের অবৈধ আয় ও সম্পদের হিসাব রাখাই ছিল তার মূল কাজ। নিজেও সবসময় ছুটতেন অবৈধ টাকার পেছনে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও মাত্র দুই দশকে বনে গেছেন শতকোটি টাকার মালিক। নিজ জেলা নেত্রকোনায় শত শত একর জমি কিনে আলোচনায় ছিলেন দীর্ঘদিন। ঢাকায় গড়ে তুলেছেন অনেক বাড়ি, প্লট ও ফ্ল্যাট। নিয়োগ-তদবির বাণিজ্য থেকে শুরু করে হারুনের মতো মাহমুদুলও নিরীহ মানুষকে জিম্মি করে টাকা নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নেত্রকোনার মদন উপজেলার বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান ২০০৫ সালে উপপরিদর্শক পদে পুলিশে যোগদান করেন। প্রশিক্ষণের পর পোস্টিং হয় ঢাকায়। ২০০৯ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও তদবির করে ঢাকাতেই আস্তানা গাড়েন। আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুর দিকে কর্মরত ছিলেন গুলশান থানায়। জুনিয়র কর্মকর্তা হলেও সে সময় হারুনের সুপারিশে বংশাল থানার অপারেশন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পান। আলোচিত ওই পুলিশ কর্মকর্তার আস্থাভাজন হয়ে মাহমুদুল প্রভাব খাটানো শুরু করেন। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জায়গা দখল, মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকারবারিদের সঙ্গে হাত মেলান। সে সময় পুলিশের গাড়ি ব্যবহার না করে চড়তেন দামি প্রাইভেট গাড়িতে। এ নিয়ে সহকর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়েন মাহমুদুল। সরকারি চাকরি করলেও ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা তাকে ডিউটি দিতে সাহস দেখাতেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরান ঢাকার বংশালে এসআর ফাইবার নামে শিটের ব্যবসা দেখিয়ে আমদানির নামে বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন মাহমুদুল। স্ত্রীকে প্রতিষ্ঠানটির মালিক দেখিয়ে অন্তত ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। মাহিরা এন্টারপ্রাইজ নামে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার আরেকটি প্রতিষ্ঠান খুলে অবৈধ উপায়ে অর্জিত বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। মিরপুর ডিওএইচএসে মাহমুদুলের রয়েছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। ৯ নম্বর সড়কের অ্যাভিনিউ ৮-এর ১০৩২ নম্বর বাড়ির ফ্ল্যাট মালিক তিনি। পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট ও গাজীপুরের সফিপুরে রয়েছে পাঁচটি ফ্ল্যাট। জয়দেবপুরে উত্তর ছায়াবীথি এলাকায় এলিফেন্ট টাওয়ারের দ্বিতীয় তলা ও সপ্তম তলার দুটি ফ্লোরের মালিক তিনি। গাজীপুর সালনা ফ্লাইওভারের পূর্বদিকে এক একরের বেশি জমি রয়েছে মাহমুদুলের। এ ছাড়া শ্রীপুর এলাকায় রয়েছে কয়েক একর জমি। গাজীপুরে মাহমুদুলের অবৈধ সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করেন মামাতো ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন। নেত্রকোনায় মদন উপজেলায় রয়েছে বিপুল পরিমাণ জমি। গ্রামের বাড়ি গঙ্গানগরে অন্তত দেড়শ একর জমি কিনেছেন। উপজেলা শহরে রয়েছে বিলাসবহুল তিনতলা বাড়ি। ওই বাড়ির তৃতীয় তলায় করেছেন অফিস। যেখানে নিয়মিত বসে মদের আসর। পুলিশ কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসানও প্রায়ই উপস্থিত থাকেন। বাড়ির পাশেই ভাটি বাংলা মার্কেটে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে। গ্রামের বাড়িতে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে ৮০ শতাংশ জমিতে পুকুর খনন করেছেন। সেখানে স্থানীয় বখাটে তরুণদের দিয়ে বসানো হয় জুয়ার আসর। এলাকার বাসিন্দাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন তারা। তাদের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশের প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় মাহমুদুল হাসান ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। আগে অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক। একেবারে শূন্য থেকে এত সম্পদের মালিক হওয়া দেখে মনে হয় আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন। মদন উপজেলা শহরে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডের সঙ্গে প্রধান সড়কে ২ কোটি টাকা মূল্যের ২২ শতক জমি রয়েছে মাহমুদুলের। ওই এলাকায় একজন ইটভাটা ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। মদন বাজারে ইমদাদপুর রোডে রয়েছে কোটি টাকা মূল্যের ৫৬ শতাংশ জমি। মাহমুদুল হাসান তার বাবা, শ্যালক ও মামা মুদি দোকানি নজরুল ইসলামের নামে বেশকিছু সম্পদ কিনেছেন।
এলাকাবাসী জানান, মাহমুদুল তার বেশিরভাগ সম্পদ মামা নজরুল, শ্যালক জনি ও বাবার নামে ক্রয় করেন। কিছুদিন পর তিনি তা নিজের বা তার স্ত্রীর নামে দান করেছেন বলে নতুন করে রেজিস্ট্রি করে নেন। দলিল করতে এটি তার অভিনব কৌশল। ময়মনসিংহ শহরে দুর্গাবাড়ি রোডে গোলপুকুর পাড় এলাকায় ২ কোটি টাকা মূল্যের ৪ কাঠা জমি কিনেছেন মাহমুদুল। তার স্ত্রীর নানাবাড়ির সম্পদের এই অংশটি শ্বশুরের নামে দলিল করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সালিশ-তদবির করতেন। নিরীহ মানুষ তটস্থ থাকতেন তার অপকর্মে। বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য কালবেলাকে বলেন, পুলিশের মধ্যে মাহমুদুলের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। বড় বড় অফিসার মাহমুদুলের ভয়ে থাকতেন। কারণ মাহমুদুল যা বলতেন, হারুন তা করতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। কোন কোন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতাকে জিম্মি করলে টাকা পাওয়া যাবে তার তালিকাও করতেন মাহমুদুল। এমনকি ধরে আনার পর কত টাকায় দফারফা করা হবে, তাও নির্ধারণ করতেন মাহমুদুল। এমনকি হারুনের গ্রামের বাড়িতে যত অনুষ্ঠান হতো, তার সবই আয়োজন করতেন তিনি। সম্প্রতি পুলিশ হেডকোয়ার্টারের অধীনে পুলিশে নিয়োগে গুরুতর অনিয়ম প্রকাশ পায়, যার সঙ্গে ওসি মাহমুদুল হাসানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। হারুনের মাধ্যমে পুলিশে চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়মের আশ্রয় নিতেন মাহমুদুল। বেশ কয়েকজনকে দিয়েছেন চাকরিও। এ ছাড়া গাজীপুরে থাকাকালে নিয়মিত আয়োজন করতেন ক্যাসিনো। নিজের তত্ত্বাবধানে এ আয়োজন থাকলেও ম্যানেজার হিসেবে রেখেছিলেন জিয়াউর রহমান নামের এক ব্যক্তিকে। এ ছাড়া সহযোগী হিসেবে ছিলেন মাহমুদুলের মামাতো ভাই মামুন আহমেদ। রূপগঞ্জ থানায় ওসির দায়িত্ব পালনকালে মাহমুদুলের মাসিক আয় কোটি টাকা ছাড়ায় বলে অভিযোগ ওঠে। ওসির শেল্টারে চোরাই তেল থেকে শুরু করে জুয়া ও মাদক স্পট চলেছে। সেসময় ওসি মাহমুদুল দম্ভোক্তি প্রকাশ করেন ‘আমি যখন যেখানে যেতে চাই সেখানেই বদলি হয়, না চাইলে কেউ বদলি করতে পারবে না।’ অপরাধীদের সঙ্গে ওসির সখ্য থাকায় সেসময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন পুলিশ সদস্যরা।
যেখানেই হারুন সেখানেই মাহমুদুল হাসান:
হারুন এডিসি থাকাকালে গুলশান জোন থেকে যেখানেই হারুন দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানেই মাহমুদুলের পদায়ন হয়েছে। হারুন লালবাগের ডিসি থাকাকালে বংশাল থানার অপারেশন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মাহমুদুল। এরপর হারুন গাজীপুরের এসপি পদে বদলি হলে তাকে নিয়ে যান জয়দেবপুর থানায়। সেখান তাকে বানানো হয় অফিসার ইনচার্জ। তারপর হারুন যখন নারায়ণগঞ্জের এসপি হিসেবে দায়িত্ব পান, সেখানেও মাহমুদ তার হাত ধরেই রূপগঞ্জ থানায় ওসি হিসেবে পোস্টিং পান। হারুন যখন ডিবিপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন আবার সেই মাহমুদুল ডিবিতে চলে আসেন এবং তার ক্যাশিয়ার হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ইন্সপেক্টর মাহমুদুল হাসান ঢাকায় সিআইডিতে কর্মরত। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘ক্যাশিয়ার ছিলাম, এ ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। দু-তিন জায়গায় কাকতালীয়ভাবে হারুন সাহেবের সঙ্গে চাকরি করেছি। ঢাকাতে আমার কোনো ফ্ল্যাট নেই, মিরপুর ডিওএইচএসে চাচা শ্বশুরের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকি। গাজীপুরে কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে জমি কিনেছি। সেখানে আধা শতক জমি আমার নামে।’ তিনি বলেন, ‘প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে হিসেবে পুলিশে চাকরি করতে অনেকের সঙ্গেই কাজ করতে হয়েছে। অনেকের কাছেই যেতে হয়েছে।’
সূত্র: কালবেলা