প্রচ্ছদ জাতীয় সেনাপ্রধানের বক্তব্য ইতিবাচক তবে অঙ্ক জটিল

সেনাপ্রধানের বক্তব্য ইতিবাচক তবে অঙ্ক জটিল

অনেক কিছুই খোলাসা করে দিলেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। দৃশ্যত নির্বাচনের একটি পথরেখা উপস্থাপন করলেন তিনি।  জোর দিলেন সংস্কারেও। পরিস্থিতি যাই হোক প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পাশে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সাক্ষাৎকারটি গতকাল ছিল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এ নিয়ে কথা বলেছেন। মুখ খুলেছেন
রাজনীতিবিদরাও। কেউই তা নাকচ করেননি।

আগস্টের প্রথম সপ্তায় একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনী গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে। দেশকে আরও বেশি রক্তপাত থেকে রক্ষা করেন তারা। শেখ হাসিনার পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তবে এরপরও নানা বিষয়ে গুঞ্জন রয়ে যায়। বিশেষত নির্বাচনের একটি সময়সীমা প্রকাশের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দাবি উঠে। সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। তবে নির্বাচনের সময়সীমার ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। সেনাপ্রধানই প্রথম এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত দিলেন।  ১৮ মাস বা দেড় বছরের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন সেনাপ্রধান। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেন তার মিশন সম্পন্ন করতে পারেন সে কথাও বলেছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার এখনো পুরোদমে সংস্কার কাজ শুরু করতে পারেনি। এরইমধ্যে একের পর এক চ্যালেঞ্জ আসছে। দৃশ্যত সংস্কারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনও দ্ব্যর্থহীন নয়। সরকার এখনো দুর্বল এবং এলোমেলো। সমন্বয় নেই নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। প্রশাসনে এখনো গতি আসেনি। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টাও চলছে। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন সব দলকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে। কারণ জনসম্পৃক্ততা না থাকলে কোনো সরকারই সফল হয় না।

এ অবস্থায় সংস্কার মিশন সম্পন্ন করা ড. ইউনূসের সরকারের জন্য সহজসাধ্য নয়। এর বাইরে জুলাই ম্যাসাকারে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করাও একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। তবে গণতান্ত্রিক নির্বাচনই যে সরকারের প্রধান কর্তব্য তাও অনেকেই বলছেন। এ পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোর অঙ্ক মেলানো একেবারেই সহজ নয়।

রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নানা ইস্যুতে কথা বলেন সেনাপ্রধান।  প্রধান উপদেষ্টাকে সহায়তা প্রশ্নে তিনি বলেছেন, তার পাশে থাকবো আমি। তাতে যা হয় হোক। এ জন্য তার পাশে থাকবো যেন, তিনি তার মিশন সম্পন্ন করতে পারেন। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পর ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করতে সহায়তা দেয়ার বিষয়ে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। রয়টার্স লিখেছে, আগস্টের শুরুর দিকে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং তার বাহিনী ছাত্রদের নেতৃত্বে প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্যে শেখ হাসিনার পাশ থেকে সরে দাঁড়ান। এতে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের পরিণতি নির্ধারণ হয়ে যায়। তিনি পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। সোমবার রাজধানী ঢাকায় নিজের অফিসে রয়টার্সকে এই সাক্ষাৎকার দেন সেনাপ্রধান। সেখানে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত অন্তর্বর্তী  প্রশাসনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন আছে তার। একই সঙ্গে সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার রূপরেখার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

উল্লেখ্য, বিশ্ব জুড়ে নন্দিত ক্ষুদ্র ঋণ আন্দোলনের প্রবক্তা ড. ইউনূস ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ তৈরি করতে বিচারবিভাগ, পুলিশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে দায়িত্বে আসা সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, এসব সংস্কারের পর দেড় বছরের মধ্যে গণতন্ত্রে উত্তরণ করা উচিত। এক্ষেত্রে তিনি ধৈর্য ধরার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, যদি আপনি আমাকে প্রশ্ন করেন, তাহলে বলবো ওটাই টাইমফ্রেম হতে পারে, যে সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করা উচিত আমাদের।

প্রতি সপ্তাহেই প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের মধ্যে সাক্ষাৎ হচ্ছে। তাদের মধ্যে ‘খুব ভালো সম্পর্ক’ রয়েছে। সেনাপ্রধান বলেন, টালমাটাল অবস্থার পর দেশে স্থিতিশীলতা আনার জন্য সরকারের প্রচষ্টায় সমর্থন আছে সেনাবাহিনীর। আমি নিশ্চিত- যদি আমরা একসঙ্গে কাজ করি তাহলে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
রয়টার্স লিখেছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭৫ সালে শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশ সেনা শাসনে চলে যায়। ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে। এর মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করে দেশ। এসব টালমাটাল সময়ের মধ্যদিয়ে পেশাদার অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেছেন, তার নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না। সেনাপ্রধান বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো কিছুই আমি করবো না। আমি একজন পেশাদার সেনা। সেনাবাহিনীতে আমার পেশাদারিত্বকে রক্ষা করবো। যদি সার্ভিসে থাকা কোনো সদস্যকে দোষী পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। তিনি আরও বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকা এজেন্সিগুলোতে কাজ করার সময় কিছু সামরিক কর্মকর্তা তাদের নির্দেশে কাজ করে থাকতে পারেন।

শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার পর থেকে প্রস্তাবিত ব্যাপক সংস্কারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেনাবাহিনীও তাদের কর্মকর্তাদের অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে। এরই মধ্যে কিছু কর্মকর্তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে বলে জানান সেনাপ্রধান। তবে এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি। দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীকে দূরে রাখতে চান সেনাপ্রধান। ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, এটা শুধু তখনই হবে যদি প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার কিছুটা ভারসাম্য থাকে, যেখানে সেনাবাহিনী সরাসরি প্রেসিডেন্টের অধীনে থাকতে পারে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বর্তমানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এই মন্ত্রণালয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন প্রধানমন্ত্রী।  সেনাপ্রধান বলেন, এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে একটি সাংবিধানিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় এটা সংশোধনের দিকে যেতে পারে। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে কখনোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা উচিত নয়। সেনাদের রাজনীতি করা উচিত নয়।

ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া আন্দোলনে সহিংসতায় কমপক্ষে এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। এই আন্দোলন দ্রুততার সঙ্গে সরকারবিরোধী রূপ নেয়। স্বাধীনতার পর এটাই ছিল এখানে সবচেয়ে রক্তাক্ত আন্দোলন। এই গণবিদ্রোহের কেন্দ্র ছিল ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকা। এর সড়কে আস্তে আস্তে স্বস্তি ফিরেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা প্রশাসনের নাটকীয় পতনের পর এখনো বেসামরিক সার্ভিস খাত যথাযথভাবে কাজ করছে না। প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার সদস্যের বাংলাদেশ পুলিশ এখনো বিশৃঙ্খল। দেশ জুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছে সেনাবাহিনী। ২০০৯ সাল থেকে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে জোরপূর্বক গুম হওয়া প্রায় ৬০০ মানুষের বিষয়ে তদন্তের জন্য হাইকোর্টের সাবেক একজন বিচারপতিকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

সূত্রঃ মানবজমিন