নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাবকে বিলুপ্ত করার দাবি জানিয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে র্যাব বিলুপ্ত করার আহবান জানিয়ে একটি খোলা চিঠি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এই চিঠি সংস্থাটি তাদের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করেছে।
সংস্থাটি দেয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, বিগত সরকারের সময় র্যাব গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত ছিল এবং এসব ঘটনার ক্ষেত্রে তাদের দায়মুক্তি ছিল। র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে যতগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর তদন্ত করার আহবান জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাটি।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের সময় ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য র্যাবকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। র্যাবের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিজিএফআইয়ের বিরুদ্ধেও এ ধরণের অভিযোগ আছে।
তবে র্যাবের তুলনায় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিজিএফআইয়ের কর্মকাণ্ড আরো বেশি ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং অপ্রকাশ্য। ডিজিএফআই নিয়ে বিস্তর অভিযোগ অনেকের মুখে মুখে থাকলেও সেগুলো নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে সাহস পায়নি।
বহু মানুষকে গুম করা কিংবা বছরের পর বছর ধরে গোপন বন্দিশালায় আটকের বিষয়টি সবার চোখের সামনে আসে শেখ হাসিনার পতন ও দেশ থেকে পালিয়ে যাবার পরে।
দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ থাকা কিছু ব্যক্তির পরিবারের সদস্য ঢাকার সেনানিবাসের ভেতরে ডিজিএফআইয়ের অফিসের সামনে জড়ো হয়। তাদের অভিযোগ ব্যক্তিরা ডিজিএফআইয়ের কাছে বন্দি রয়েছে। এরপর ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে অন্তত তিনজনকে পাওয়া যায়, যারা পাঁচ থেকে আট বছর পর্যন্ত নিখোঁজ ছিলেন।
র্যাব বিলুপ্ত করা প্রয়োজন?
এ বিষয়টি নিয়ে দুই ধরণের মতামত কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, র্যাব বিলুপ্ত করার কোন বিকল্প নেই। তবে সেনাবাহিনীর সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, র্যাব বিলুপ্ত না করে সেটির সংস্কার করা জরুরী এবং এই বাহিনীকে যাতে ভবিষ্যতে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না করা যায় সেটি নিশ্চিত করা জরুরী।
উল্লেখ্য, র্যাব পুলিশের অধীনে একটি বাহিনী হলেও এর কর্মকর্তাদের বড় অংশ আসেন বিভিন্ন সামরিক বাহিনী থেকে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, র্যাব-এর বহু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা ধরণের গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা আছে। এর বেশ কিছু আদালতে প্রমাণও হয়েছে। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলছেন, সার্বিকভাবে র্যাব-এর ইমেজ এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে সেখান থেকে র্যাবকে টেনে তোলা মুশকিল।
“র্যাব বর্তমানে যেভাবে কাজ করছে, এভাবে একটা বাহিনী পরিচালনার সুযোগ নেই। র্যাব ইমিডিয়েট বিলুপ্ত করা দরকার। কারণ তারা সমাজে একটা ভীতিকর অবস্থা তৈরি করেছে,” বলেন লিটন।
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের এলিট ফোর্স-এর কোন প্রয়োজন নেই। পুলিশকে ঢেলে সাজিয়ে দক্ষতা বাড়ালে এলিট ফোর্সের কোন প্রয়োজন নেই। বাহিনী হিসাবে র্যাব সবচেয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’র কারণে।
বাংলাদেশে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সন্ত্রাসীদের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে র্যাবের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ার’ যেন এক সময় অনেকটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
র্যাবের কর্মকাণ্ড তখন থেকেই বিদেশিদের নজরে আসতে থাকে। র্যাব গঠনের দুই বছরের মাথায় ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে যে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন সেখানে এ চিত্র ফুটে ওঠে। উইকিলিকসে সেই তারবার্তা প্রকাশিত হয়।
মার্কিন তারবার্তায় বলা হয়েছিল, “র্যাবের সবচেয়ে পরিচিত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্রসফায়ার নামের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যার কারণে পথঘাট নিরাপদ হয়ে উঠেছে বলে তারা দাবি করেছে। প্রতিবারের গল্প প্রায় একই রকম।”
‘ক্রসফায়ার’ ছাড়াও র্যাবের বিরুদ্ধে ঘুষ, চাঁদা নেওয়া কিংবা অন্যের হয়ে জমি দখল করার মতো নানা অভিযোগও দানা বাঁধতে থাকে। র্যাবের বিরুদ্ধে আরেকটি গুরুতর অভিযোগ আসে সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের তুলে নেওয়া। বিশেষ করে ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে এ ধরনের ঘটনার বেশ কিছু অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে এসেছিল।
অনেকটা আকস্মিকভাবে ২০২১ সালের ১০ই ডিসেম্বর আমেরিকার দিক থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় র্যাব বাহিনী এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার উপর। সেখানে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগ আনা হয়। অবশ্য আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দেবার পর থেকে গত দুই বছরে র্যাব-এর হাতে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হবার ঘটনা নেই বললেই চলে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এম মুনিরুজ্জমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, র্যাব একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের কাঠামো চালানোর জন্য এ ধরণের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আছে। তিনি মনে করেন, র্যাবকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সেটি হচ্ছে সমস্যা।
“এসব প্রতিষ্ঠানে যেভাবে ব্যক্তির পদায়ন করা হয়েছিল সেটা হচ্ছে সমস্যা। তাদের কোন জবাবদিহিতা ছিল না। র্যাব যেসব কাজ করছিলে সেগুলো কিছুটা করছিল নিজেরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং বেশি কাজ করেছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের আদেশ পালনের জন্য।”
অনেকে মনে করছেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে শুধু বাহিনী বিলুপ্ত করে নতুন বাহিনী তৈরি করে কোন লাভ হবে না। “উপর থেকে নির্দেশ দিয়ে এগুলোকে নষ্ট করা হয়,” বলছিলেন অবসরপ্রাপ্ত লেফট্যানেন্ট জেনারেল মইনুল ইসলাম, যিনি বিজিবির মহাপরিচালক ছিলেন।
তবে র্যাব-এ সংস্কার করার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন। তার মতে, র্যাব কাউন্টার টেরোরিজম ফোর্স হিসেবে থাকতে হবে।
তবে র্যাব নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনা কী? এনিয়ে কথা বলার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একাধিক উপদেষ্টার সাথে যোগযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।
ডিজিএফআই নিয়ে কী করবে?
মানবাধিকার কর্মীরা ডিজিএফআইকে ‘নাটের গুরু’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। তাদের মতে দেশে গুম হাবার ঘটনাগুলো ‘সমন্বয়’ করেছে, নতুবা ‘উৎসাহিত’ করেছে।
মনিরুজ্জামান বলেন, ডিজিএফআইয়ের প্রধান কাজ হচ্ছে তিনটি বাহিনীর ওপরে গোয়েন্দা নজরদারি করা। এছাড়া প্রতিবেশী দেশে কী ধরণের পরিবর্তন হচ্ছে এবং বাংলাদেশকে সেটি কীভাবে প্রভাবিত করছে সেটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা।
আইন অনুযায়ী রাজনীতির সাথে ডিজিএফআইয়ের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি মনে করেন, সংসদীয় কমিটির কাছে গোয়েন্দা প্রধানদের জবাবদিহিতা থাকতে হবে। কিন্তু এসব বাহিনীর কোথাও কোন জবাবদিহিতা নেই।
“আমাদের এখানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীন। তারা কারো কাছে জবাবদিহি করে না। সরকার প্রধান ছাড়া তারা অন্য কারো কাছে জবাবদিহি করে না,” বলেন সাবেক মেজর জেনারেল এম মনিরুজ্জামান।
মি. খান মনে করেন, ডিজিএফআইয়ের কর্মকাণ্ডকে সেনানিবাসের ভেতরে সীমাবদ্ধ করতে হবে। সেনানিবাসের বাইরে যাতে তাদের কোন ভূমিকা না থাকা সেটি নিশ্চিত করা জরুরী।
“এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা যে আইন বহির্ভূত কাজ করছিলেন সেটি নিয়ে তারা অবগত ছিলেন। অবগত থাকার পরেও তারা কোন পদক্ষেপ নেননি। ”
মি. খান বলছেন, অতীতে দেখা গেছে, ডিজিএফআই কোন একটি পক্ষের হয়ে ব্যাংক দখলে ভূমিকা রাখা কিংবা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মতো কাজ করেছে।
এমনকি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার প্রকাশ্যে বলেছেন যে সরকারে সাথে বিরোধের পর তাকে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে ডিজিএফআই।
“এই যে অপরাধগুলো তারা সংগঠিত করেছে বিগত দিনে, এটার জন্য দুই চারজন ব্যক্তির ওপর দায় চাপালে হবে না। পুরো সংস্থাটির ওপর এই অভিযোগ আসে,” বলেন মি. খান। যারা এসব অপরাধের সাথে জড়িত ছিল তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনলে একটি কঠোর বার্তা দেয়া হবে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় সরব একটি সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ গত ৬ই অগাস্ট ঢাকা সেনানিবাসে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিজিএফআইয়ের অফিসের সামনে জড়ো হয়েছিল। তখন বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র প্রতিষ্ঠান আন্তবাহিনী জন:সংযোগ পরিদপ্তরের সাথে বিবিসি বাংলার তরফ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ডিজিএফআইয়ের তরফ থেকে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সাবেক লেফট্যানেন্ট জেনারেল মইনুল ইসলাম মনে করেন, সব সংস্কারের সাথে রাজনৈতিক বিষয়ও জড়িত থাকে। “যারা রাজনীতি করবেন, তারা যদি সঠিক রাজনীতি না করেন, তাহলে তো এটা নষ্ট হয়ে যাবে,” বলেন মি.ইসলাম।
বাহিনী বিলুপ্তির উদাহরণ
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বাহিনী বিলুপ্ত হবার উদাহরণ রয়েছে বাংলাদেশে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রক্ষীবাহিনীকে বিলুপ্ত করা হয়েছি। রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল।
সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার রাজনীতিতে জড়িয়ে পরার ঘটনা উন্নত বিশ্বে দেখা না গেলেও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে সেটি অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’ বিষয়। এ ধরণের উদাহরণ দেখা যায় পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআই-এর ক্ষেত্রে।
দশকের পর দশক ধরে আইএসআই পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে এবং যখন যে ক্ষমতায় ছিল তাদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা এবং নানা দমন-পীড়নের জন্য আইএসআইকে অভিযুক্ত করা হয়।
এমন প্রেক্ষাপটে ২০০৮ সালে আইএসআই-এর রাজনৈতিক শাখা বিলুপ্ত করে দেশটির সরকার। পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশী তখন বলেছিলেন, আইএসআই একটি মূল্যবান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এখন থেকে তারা শুধু সন্ত্রাস-বিরোধী কাজ মনোনিবেশ করবে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা, thedailycampus