ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন শেখ হাসিনা। বিভিন্ন দেশে তার যাওয়ার শোনা যাচ্ছিল কিন্তু তিনি এখনো সে দেশেই আছেন। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী-এমপিদের লাল পাসপোর্ট বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই পাসপোর্ট বাতিল হলে শেখ হাসিনা কতদিন ভারতে থাকতে পারবেন তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে।
কারণ যে পাসপোর্টের বলে শেখ হাসিনা ভিসা ছাড়াই ভারতে অবস্থান করছেন, সেই কূটনৈতিক বা লাল পাসপোর্ট বাতিল হয়ে যাবে স্বাভাবিক নিয়মে। অন্যদিকে গত কয়েক দিন হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি হয়েছেন শেখ হাসিনা। তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের আওতায় আনারও দাবি উঠেছে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে বন্দিবিনিময় চুক্তি রয়েছে, তার আওতায় শেখ হাসিনাকে ভারত সরকার আদৌ বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে কি না, সেটি নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।
দিল্লির পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেখ হাসিনা ভারতের প্রায় ৫০ বছরের পুরনো বন্ধু। তাকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দিতে চেষ্টা করবে দেশটি। সে ক্ষেত্রে বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় তাকে বাংলাদেশে ফেরানো কঠিন হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে ভারত সরকার নানা কৌশল অবলম্বনের পাশাপাশি সময়ক্ষেপণ করতে পারে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরার আসামি ও বন্দিদের একে অন্যের কাছে হস্তান্তরের জন্য একটি চুক্তি আছে সেই ২০১৩ সাল থেকেই।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন গত সপ্তাহে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব মামলা রুজু হচ্ছে, তার ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে ভারতকে এ প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানানো হবে কি না। সে ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হবে।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে সত্যিই যদি এ ধরনের কোনো অনুরোধ আসে, সে ক্ষেত্রে ভারত সরকারের অবস্থান কী হবে সে বিষয়টি নিয়েও দিল্লি আপাতত মুখ খুলতে চাইছে না।
তবে বাস্তবতা হলো, ওই চুক্তির আওতায় যদি প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানানোও হয়, তাহলে সেই অনুরোধ রক্ষা করার কাজটা যে সহজ হবে না, সেটা ঢাকারও বিলক্ষণ জানা। কারণ ওই চুক্তিতে এমন কতগুলো বিধান বা শর্ত আছে, যার যেকোনোটি ব্যবহার করে ভারত এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। নানা আইনি জটিলতা বা মারপ্যাঁচ দেখিয়েও সেই অনুরোধ ফেলে রাখতে পারে দিনের পর দিন।
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত প্রত্যর্পণ চুক্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো যার হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগটা যদি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতি’র হয় তাহলে সেই অনুরোধ খারিজ করা যাবে। তবে কোন কোন অপরাধের অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক’ বলা যাবে না, সেই তালিকাও বেশ লম্বা যার মধ্যে হত্যা, গুম, অনিচ্ছাকৃত হত্যা ঘটানো, বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো ও সন্ত্রাসবাদের মতো নানা অপরাধ আছে।
গত দুই সপ্তাহে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যেসব মামলা রুজু হয়েছে তার মধ্যে হত্যা, গণহত্যা, গুম ও নির্যাতনেরও নানা অভিযোগ আছে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে এগুলোকে ‘রাজনৈতিক’ বলে খারিজ করা কঠিন।
২০১৬ সালে যখন মূল চুক্তিটি সংশোধন করা হয়, তখন এমন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছিল, যা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বেশ সহজ করে তুলেছিল। সংশোধিত চুক্তির ১০(৩) ধারায় বলা হয়েছিল, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেই সব অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ না করলেও চলবে। শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যেসব মামলা হয়েছে, তার কোনোটিতে যদি আদালত ‘ফেরার’ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেয়, তাহলে তার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে তার হস্তান্তরের অনুরোধ জানাতে পারবে।
চুক্তিটির একটি ধারায় বলা আছে যদি অনুরোধ-প্রাপক দেশের মনে হয় ‘অভিযোগগুলো শুধু ন্যায়বিচারের স্বার্থে, সরল বিশ্বাসে আনা হয়নি’ তাহলেও তাদের সেটি নাকচ করার ক্ষমতা থাকবে। অভিযোগগুলো যদি ‘সামরিক অপরাধে’র হয়, যা সাধারণ ফৌজদারি আইনের পরিধিতে পড়ে না তাহলেও একইভাবে অনুরোধ নাকচ করা যাবে।
এখন ভারত যদি সত্যিই শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের কোনো অনুরোধ পায়, তাহলে এ ধারাটি প্রয়োগ করেই তা খারিজ করা যাবে বলে দিল্লিতে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
স্ট্র্যাটেজিক থিংকট্যাংক আইডিএসএর সিনিয়র ফেলো স্মৃতি পট্টনায়ক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমি মনে করি না বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকার ভারতের কাছে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানাবে। এতে দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। যে ঝুঁকিটা হয়তো বাংলাদেশের এ সংকটময় পরিস্থিতিতে সদ্য দায়িত্ব নেওয়া একটি সরকার নেবে না।’ সে সঙ্গে তিনি এও যোগ করেন, ‘তবে তারপরও যদি এ অনুরোধ জানানো হয়, তাহলেও সেটা রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক বলে মনে করার জন্য ভারতের হাতে কিন্তু যথেষ্ট যুক্তি থাকবে। যেমন ধরুন, মঙ্গলবারই আদালতে তোলার সময় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে যেভাবে কিল-ঘুসি মারা হলো, কিংবা তার আগে সাবেক শিল্প উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বা সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে আদালতে হেনস্তা হতে হলো তাহলে বিচারের জন্য বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া হলে শেখ হাসিনারও যে একই পরিণতি হবে না, এ নিশ্চয়তা কে দেবেন?’
তবে ভারতে আরেক দল বিশ্লেষক মনে করেন, যদি সত্যিই শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করার জন্য ভারতের কাছে কোনো অনুরোধ আসে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বা সরাসরি তা নাকচ না করে দিল্লি দিনের পর দিন তা ঝুলিয়েও রেখে দিতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী আবার মনে করিয়ে দেন, এ ধরনের চুক্তির আওতায় অনুরোধ মঞ্জুর হতে এমনিতেও অনেক সময় বছরের পর বছর লেগে যায়। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘মুম্বাইয়ে ২৬/১১-এর জঙ্গি হামলার ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত তাহাউর হুসেন রানা, যিনি একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক, তাকে হাতে পাওয়ার জন্য ভারত চেষ্টা চালাচ্ছে সেই ২০০৮ সাল থেকে। এখন ধরুন, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে কিন্তু সেই ১৯৯৭ সাল থেকে। অন্য বহু দেশেরও আগে আমেরিকার সঙ্গে ভারত এ চুক্তি করেছে, ফলে এতদিনে তাকে তো ভারতের হাতে পেয়ে যাওয়াই উচিত ছিল, তাই না?’
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাচ্যুত সরকারের এমপি, মন্ত্রী এবং বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ও চুক্তি বাতিল হওয়া কর্মকর্তাদের লাল পাসপোর্ট বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর, যেটি শিগগির কার্যকর হবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
সাধারণত দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা লাল পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, উচ্চ আদালতের বিচারপতি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সচিব, সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা এবং বিদেশে বাংলাদেশি মিশনের কর্মকর্তারাও এই পাসপোর্ট পান। লাল পাসপোর্টধারীদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য কোনো ভিসার প্রয়োজন হয় না। তারা সংশ্লিষ্ট দেশে অবতরণের পর অন-অ্যারাইভাল ভিসা পান। কূটনৈতিক পাসপোর্ট সব দেশেই লাল রঙের হয়ে থাকে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, যারা এখন পদে নেই, শুধু তাদের লাল পাসপোর্টই বাতিল হবে। আর যারা পদে আছেন, তাদের লাল পাসপোর্ট থাকছে। সে ক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যেহেতু পদে নেই, তাই বাতিল হবে তার লাল পাসপোর্ট।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ভারতে যান। তখন থেকে তিনি দেশটিতে অবস্থান করছেন। শেখ হাসিনা কোন মর্যাদায় ভারতে আছেন, সে বিষয়ে দেশটির সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। এ বিষয়ে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার যে পাসপোর্ট রয়েছে, সেটির সুবাদে তিনি অন্তত দেড় মাস কোনো ভিসা ছাড়া ভারতে অবস্থান করতে পারেন।
২০১৮ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ‘সংশোধিত ট্রাভেল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ নামে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। তাতে উল্লেখ আছে, উভয় দেশের ডিপ্লোম্যাটিক ও অফিশিয়াল পাসপোর্টধারীদের ৪৫ দিনের মেয়াদে ভিসা ছাড়াই বসবাসের জন্য (ভিসা ফ্রি রেজিম) থাকতে দিতে দুই দেশ পারস্পরিকভাবে রাজি হয়েছে। ওই পাসপোর্টের সুবাদে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিসা ছাড়া ভারতে অবস্থান করছেন।
তিনি দেশ ছেড়েছেন ১৮ দিন আগে। আরও ২৭ দিন তিনি ভিসা ছাড়া সেখানে অবস্থান করতে পারবেন। তবে এ সময়ের আগে যদি তার লাল পাসপোর্ট বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তাকে বিকল্প চিন্তা করতে হবে। একই সঙ্গে ভারতকেও এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে।
অন্যদিকে শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যের পাসপোর্টধারী। ফলে তিনি ভারতে অন-অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা পাবেন। এ সুবিধায় তিনি যতদিন খুশি ভারতে থাকতে পারবেন।