সারাদেশ: ভারতের ত্রিপুরার উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণে দেশের অন্তত ১০ জেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যায় বিপর্যস্ত এসব জনপদের ৩৬ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বানের পানিতে রাস্তা ডুবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে সড়ক যোগাযোগ। বিদ্যুৎ না থাকায় অচল হয়ে পড়েছে ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেননি। বেশিরভাগ মানুষের ঘরে শুকনো খাবারও নেই। যাদের ঘর ডুবে গেছে, তাদের উদ্ধার করতেও বেগ পেতে হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এল-নিনো, জেট স্ট্রিম, বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি লঘু চাপসহ বেশকিছু প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ওপর একই সময়ে সক্রিয়ভাবে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে করে উঁচু এলাকাগুলো থেকে নেমে আসা ঢলই আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি করেছে। তবে বন্যা দেখা দেওয়ার শুরুতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে যে, ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতী জেলার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডম্বরু স্লুইস গেট খুলে দেওয়ার ফলেই বাংলাদেশে এমন বিস্তীর্ণ বন্যা সৃষ্টি হয়েছে। স্লুইস গেট খোলার প্রতিবাদে বিভিন্ন শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিলও হয়েছে। যদিও এটি বাংলাদেশের বন্যার একক কারণ নয় বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রকৃতপক্ষে অতিবৃষ্টির কারণেই ফেনীসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, আর সেই বন্যা ব্যাপক আকার ধারণ করে ডম্বুর গেট খুলে দেওয়ার পর। তবে ভারত স্লুইস গেট খোলার আগে বাংলাদেশকে আগাম সতর্ক করতে পারতো, এমন আলোচনাও উঠে এসেছে। সর্বোপরি বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় কেবল ভারতের ‘বাঁধ খুলে দেওয়ার’ বিষয়টিকে কটাক্ষ করে অনেকে বলছেন, ‘বাঁধের বিপরীতে বাঁধ বানাতে কত টাকা লাগে? জনগণ টাকা দেবে, দরকার হলে জনগণ বিনা পয়সায় বাঁধের কাজ করবে, তবুও এই ট্র্যাজেডি আর দেখতে চাই না।’ অর্থাৎ তারা ভারতের বাঁধগুলোর কাছাকাছি দূরত্বে আরও উঁচু বাঁধ তৈরি করে পানির প্রবাহ ঠেকানোর কথা বলছেন। এমন পোস্ট এখন ফেসবুকে ট্রেন্ডিং। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বানও জানাচ্ছেন নেটিজেনদের বড় অংশ।
তবে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানি বা পক্ষান্তরে বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া ঠেকাতে বাঁধ কোনো কাজে আসবে কিনা, সে বিষয়ে বিশ্লেষণী আলোচনাও দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। স্রেফ আবেগের বশবর্তী হয়ে মন্তব্য না করে যুক্তি দিয়ে ভাবার পক্ষে জোর দেওয়া হয়েছে এতে। যেমন, মো. তানভীরুল ইসলাম অমিয় নামের এক প্রকৌশলী বলেছেন, ‘বাঁধের সামনে আরেকটা বাঁধ নির্মাণ কি সত্যিই কোন বাস্তবসম্মত সমাধান, নাকি মানুষের সরল মনের ফ্যান্টাসি, সেটা আগে বুঝতে হবে।’ ভারতের বাঁধের সন্নিকটে বাংলাদেশও বাঁধ নির্মাণ করতে পারে কিনা, এ ব্যাপারে বিস্তারিত একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন প্রকৌশলী মো. তানভীরুল ইসলাম অমিয়। তিনি গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (আইইউটি) পূরকৌশলে পড়াশোনা করেছেন। ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্পেশালাইজেশন রয়েছে তার। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত এবং গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেছেন, “পরিকল্পনা ছাড়া ভারতের সব ট্রান্সবাউন্ডারি রিভারের বাঁধের সামনে আরেকটা বাঁধ নির্মাণ শুরু করলে বাংলাদেশ পুরোপুরি মরূভূমিতে পরিণত হবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন, তিস্তা নদীর উপর ভারত যে বাঁধ নির্মাণ করেছে সেটার নাম ‘গাজলদোবা বাঁধ’। তার একটু ডাউনস্ট্রিমেই বাংলাদেশে নীলফামারীতে তিস্তা নদীর উপরেই রয়েছে ‘তিস্তা বাঁধ’। এই তিস্তা বাঁধ উত্তরাঞ্চলে ‘মঙ্গা’ মোকাবেলায় খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও এত অল্প দূরত্বে দুইটি বাঁধ নদীর ডাউনস্ট্রিমকে একদম ধূ ধূ বালুতে পরিণত করেছে।” অমিয়র স্ট্যাটাসটি অনেক প্রকৌশলী, গবেষক, পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিরা শেয়ার করেছেন।
বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া আরও একটি স্ট্যাটাস এমন যে, ‘সময় হয়েছে, ফারাক্কার ৪০ কিলোমিটার দুরে ৭৫০০ ফিট উচ্চতার দ্বিতীয় ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। মাঝরাতে ঘুমন্ত অবস্থায় বাঁধ খুলে দিয়ে ভারত পৈচাশিক আনন্দ পাচ্ছে৷ এরপর তারা বর্ষায় বাঁধ খুলে দিলে পানি এই ৪০ কিলোমিটারের মধ্যেই থাকবে, আর যদি এর চেয়ে বেশি পানি ছাড়ে, তাহলে সেই পানি তাদের দেশেই ফেরত যাবে, কারণ তাদের বাঁধের উচ্চতা থাকবে আমাদের চেয়ে কম, ৭৩৫০ ফিট!’ এ ধরনের দাবির ব্যাপারে তরুণ প্রকৌশলী তানভীরুল ইসলাম অমিয় বলেছেন, ‘ভারত বাঁধ খুলে দিলে আমরা আমাদের বাঁধ বন্ধ করে দিব, বন্যার পানি আবার ভারতে চলে যাবে, এটা শুনতে খুব মজার মনে হলেও ব্যাপারটা এত সহজ না। নদীর ধর্ম হচ্ছে আপস্ট্রিম থেকে ডাউনস্ট্রিমে যাওয়া। তাই আপনি বাংলাদেশ অংশে একটা বাঁধ নির্মাণ করে দিলেই নদী রিভার্স দিকে প্রবাহিত হওয়া শুরু করবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। এক্ষেত্রে দুটো জিনিস হতে পারে— নদী ব্যারেজের আশেপাশে আরেকটা বিকল্প রুট তৈরি করে সেদিক দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করবে, অথবা নদীর পানি বাঁধের একদম আপস্ট্রিমেই জমা হতে হতে এক সময় বাঁধ ভেঙে ফেলবে বা ওভারটপ করবে। দুই সিনারিওতেই কিন্তু পরিণতি একই— বাংলাদেশে আরও ভয়ানক ফ্ল্যাশ ফ্লাড এবং তীব্র নদী ভাঙন।’
তাহলে বন্যা মোকাবিলায় করণীয় কী— জানতে চাইলে এবারের প্রেক্ষাপট টেনে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ বলেছেন, ‘কুমিল্লা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদী ও ফেনী জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত মুহুরী নদীর উজানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে একাধিক বাঁধ দিয়েছে দেশটির সরকার। সেখানে আছে ব্যারেজও। এসব বাঁধ ও ব্যারেজের কোনোটি পানি সংরক্ষণের জন্য, কোনোটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কিংবা কৃষিকাজের জন্য। জুন মাসে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার ফলে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ের আগেই এসব ড্যাম ও ব্যারেজ পরিপূর্ণ ছিল। ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ত্রিপুরা রাজ্যের সব ড্যামের পানি ধারণক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে যায় এবং ২০ আগস্ট রাতে হঠাৎ করেই বেশির ভাগ ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খুলে দেয় ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারা বাংলাদেশ সরকারকে আগে থেকে কোনো তথ্য দেয়নি। অর্থাৎ, এ ধরনের পরিস্থিতিতে কূটনীতি খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ প্রকৌশলী ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রামের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী তুনাজ্জিনা রহিমু বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অস্বীকার করার বা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে দুর্যোগকে মোকাবিলা করে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন হয় পূর্বপ্রস্তুতি বা প্রিপেয়ার্ডনেস। যদি এতে দুই দেশের মধ্যকার সীমারেখার বিষয়ও থাকে, সেক্ষেত্রে চুক্তি বা আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে আমাদের নানামুখী প্রস্তুতি প্রয়োজন। বন্যা নিয়মিত এবং প্রতিবছরই প্রত্যাশিত একটি দুর্যোগ। আশঙ্কার বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এটি যেকোনো সময়ের চাইতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট সাইকেলের প্রতিটি ধাপ অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এদিকে যুক্তরাজ্যে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের সহযোগী অধ্যাপক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ বায়েস আহমেদ বলেছেন, ‘ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহমান ৫৪টি প্রধান এবং অতিগুরুত্বপূর্ণ নদীর প্রায় সবগুলো নদীতেই ভারত একাধিক বাঁধ তৈরি করেছে। এই স্থাপনাগুলো বাংলাদেশ সীমানার খুব কাছে অবস্থিত; যদিও এই নদীগুলোর উৎস আরও বহু দূরের কোনো পর্বত বা হিমবাহ থেকে। যেমন ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরে। তিস্তা, গোমতী নদীর উপর মহারানী বাঁধ, ডম্বুর বাঁধও খুব কাছে। এ বিবেচনায় বলা যায় বর্ষাকালে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি বড় আকার ধারণ করার বিষয়টি অনেকাংশে মানবসৃষ্ট এবং এর পেছনে ভারতের দায় রয়েছে। তাদের ভুল সিদ্ধান্ত বা গঠনমূলক পরামর্শের ঘাটতি আমাদের জন্য দুর্যোগ ডেকে আনছে।’এ ব্যাপারে প্রকৌশলী তানভীরুল ইসলাম অমিয় আরও বলেছেন, ভারতের সঙ্গে অতিদ্রুত পানিবন্টন চুক্তি করতে হবে। ভারত সরকার বাংলাদেশের বর্ডারে প্রায় ৩০টি বাঁধ নির্মাণ করেছে। অথচ একমাত্র ফারাক্কা বাঁধ ছাড়া আর কোনো বাঁধের ব্যাপারে পানিবণ্টন চুক্তি নেই। তাছাড়া কোনো প্রকার গাইডলাইন ফলো না করে এক রাতের মধ্যে বাঁধের সব কয়টি দরজা খুলে দেওয়ার মতো কাজ মেনে নেওয়া যায় না। একে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
তবে কূটনীতি ছাড়াও অবকাঠামোগত প্রস্তুতির ব্যাপারে কয়েকটি বিষয়ে তিনি আলোকপাত করতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, সেচ প্রকল্প বা মেগা স্কেলে রিজার্ভার প্রকল্প হাতে নিতে হবে। কৃত্রিম খাল বা রিজার্ভার খনন করে রাখা যেতে পারে, যা প্রতি বর্ষা মৌসুমে বন্যার সময় নদীর পানি উপচে পড়ার পর জমা করবে। খরার মৌসুমে চাষাবাদের কাজেও এটি ব্যবহার করা যাবে। আরেকটি সহজ প্রক্রিয়া হল, নদীর নাব্যতা রক্ষা করা। উজানের ঢলে আসা পলি জমা হয়ে নদীর প্রস্থ এবং গভীরতা দ্রুত কমে যাচ্ছে, পানি ধারণ ক্ষমতা কমছে। পরিকল্পিত ড্রেজিং এক্ষেত্রে জরুরি। নদীমাতৃক দেশের নদীর নাব্যতা ধরে রাখা, পানির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট দরকার। অন্যদিকে আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে এবারের ভারী বৃষ্টির এই পূর্বাভাস জানাতে ব্যর্থতার জন্য পুরোপুরি দায়ী বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। তারা কেন ব্যর্থ হলেন, গণমাধ্যমকর্মীদের উচিত সেই ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া। আগে থেকে পূর্বাভাস পাওয়া গেলে মানুষ বন্যার প্রস্তুতি নিতে পারতো। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন আবহাওয়া পূর্বাভাসের মডেল বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করেও সঠিক পূর্বাভাস নির্ণয় করা যায়। ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেকে সেটি করছেন। সেই হিসেবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতো বিশেষায়িত সংস্থার দায়বদ্ধতা আরও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু তারা এখনো গৎবাঁধা বুলেটিনেই আটকে থাকছেন। এতে করে দুর্যোগ মোকাবিলা করা কঠিন হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষ যা কিছুই আলোচনা করুক না কেন, দায়িত্বশীলদের উচিত তাদের দায়িত্বের জায়গা থেকে একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় করে কার্যকরী ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ গ্রহণ করা।’