জাতীয়: ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখান ট্রাজেডি বা বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সাহারা খাতুন। আর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন সোহেল তাজ।
অভিযোগ উঠেছিল, পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনার পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন সোহেল তাজও। যদিও সোহেল তাজের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ঘটনার সময় তিনি দেশের বাইরে ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ১৫ আগস্ট বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন সোহেল তাজ। তিনি শুরুতেই ‘সত্য বলার সময় এসেছে’ লিখে সেখানে তিনি নিজেকে পিলখানা ট্রাজেডিতে নির্দোষ দাবি করেন।
অভিযোগের বিষয়ে সোহেল তাজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বসে যখন ঘটনার খবর পান তখনই তিনি পুলিশের আইজির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে কথা বলেন। একপর্যায়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তার পরামর্শ না শুনে তাকে ধমক দিয়েছেন।
তিনি বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে কিছু মহল আমাকে জড়াতে চেষ্টা করেছে। এরকম নিকৃষ্ট একিউজিশন খুবই দুঃখজনক। একজন নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে এমন একটা কালিমা দেওয়া ঠিক না।
তিনি আরও বলেন, আমি তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলাম। কিন্তু ঘটনার সময় আমি আমেরিকা ছিলাম। আমার মেয়ের জন্মদিনও ছিল আর আমার ঘনিষ্ঠ একজন আত্মীয়ের হার্ট সার্জারি হচ্ছিল নিউ ইয়র্কে। পিলখানার পাশেই আমার এক আত্মীয়ের অফিস। আমেরিকা ও বাংলাদেশের মধ্যে সময় ব্যবধান ছিল ১১ ঘণ্টা। রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমার ওই আত্মীয় কল করে বলেন, সোহেল এখানে তো অনেক গোলাগুলি হচ্ছে। তখন আমি বলি গোলাগুলি মানে? তখন তিনি বলেন, গোলাগুলি মানে অনেক গোলাগুলি। তখন সঙ্গে সঙ্গে আমি ফোন দিলাম তৎকালীন আইজিপি নূর মোহাম্মদকে। ওনাকে বললাম আইজি সাহেব পরিস্থিতি কী? কি হচ্ছে সেখানে।
ওনি বললেন, গোলাগুলি হচ্ছে পিলখানায়। আমি বললাম গোলাগুলি হচ্ছে তো আপনারা কি করছেন? তিনি বললেন আমরা তো আছি। এ কথা শুনে আমি বলেছিলাম পুলিশ, র্যাব, আনসার, এপিবিএন সব ডাকেন। সবাইকে দিয়ে পুরো পিলখানা ঘেরাও দেন। মুভিং করতে হবে। ওনি বললেন, আমরা তো মুভিং করছি। প্রয়োজনে সেনবাহিনীকে ডাকার কথাও বলি। আমার কথা শুনে তখন আইজি আমাকে বললেন, স্যার মন্ত্রী মহোদয় সঙ্গে আছেন। তার মানে ওনি আমাকে বলতে চাচ্ছেন আপনার কথা আমি মানতে পারবো না কারণ সিনিয়র আছেন। তখন আমি বুঝে গেলাম তিনি আমার কথা শুনবেন না কারণ আমার সিনিয়র (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) আছেন।
সোহেল তাজ বলেন, আমার মাথা তখন গরম হয়ে গেছে। এরকম ক্রাইসিস হলে পুরো এলাকা ঘেরাও করতে হয়। যাতে ভেতরে যারা আছে তারা যেন বুঝতে পারে তাদের পালাবার কোনো পথ নাই। পালানোর পথ যদি না থাকে তবে তারা যা করতে চাচ্ছে সেটা নাও করতে পারে। সেজন্য বলেছিলাম পুরো এলাকা সবদিক দিয়ে ঘেরাও করতে হবে। আইজি’র কথা শুনে আমি থেমে যাইনি। ফোন রেখে আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকে ফোন করলাম। ওনাকেও আমি একই কথা বললাম। ঘেরাও দেয়ার জন্য। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে কল করার কথাও বলি। ওনি তখন আমাকে বললেন বাবা এটা তো আপা (শেখ হাসিনা) দেখছেন। আমি তখনও থামি নাই। প্রধানমন্ত্রীকে কল করে একই কথা বলেছি। যা ফোর্স আছে তা দিয়ে ঘেরাও করে রাখতে হবে। আর্মি আসার আগ পর্যন্ত এটা করতে হবে। ওনি আমাকে বললেন, তুমি আমেরিকায় বসে বসে বেশি বুইঝো না। আমি দেখতেছি। তখন আমার আর কিছু করার ছিল না।
তিনি বলেন, দেশে এসে আমি যা দেখলাম সেটাতেও অবাক হয়েছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল বিডিআর। কিন্তু অলৌকিকভাবে সব কাজ হয়ে যাচ্ছে। আমি দেখতে পারছি না কি হচ্ছে। কো-অর্ডিনেটর করে দেয়া হয়েছে কর্নেল ফারুক খানকে। ওনি তখন বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। বাণিজ্যমন্ত্রীকে কেন এই ঘটনার কো-অর্ডিনেটর করতে হবে? তারপর থেকে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেল। আমাদের হাতে আর কিছুই ছিল না। বিডিআরের ‘ব’ পর্যন্ত আমরা বলতাম না। কারণ আমাদের কাছে কেউ জানতেও চায়নি, বলেওনি। এভরিথিং ওয়াজ ডান বাই দ্য কো-অর্ডিনেটর। আমার কাছে সবই উদ্ভট লেগেছে। কিন্তু প্রমাণ তো নাই। প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের এটাও একটা কারণ ছিল। তাই বিডিআর বিদ্রোহের পরপরই আমি পদত্যাগ করেছি।
বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্য কী ছিল? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, মন্ত্রী থাকাকালীনই আমি কিছু দেখিনি, কিছুই টের পেতাম না। কোথা দিয়ে কি চলে যাচ্ছে, কী হয়ে যাচ্ছে কিছুই জানতাম না। আর দায়িত্ব ছাড়ার পর আর কিছু দেখার বা জানার সুযোগ ছিল না।
এর আগে সোহেল তাজ ১৫ আগস্ট এক ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, সত্য বলার সময় এসেছে। সত্যই হচ্ছে সবচেয়ে বড় শক্তি। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্বল হচ্ছে তার আত্মসম্মান আর মর্যাদা এবং সত্যই হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার আর ঢাল। তিনি লিখেছেন, ‘আপনারা যারা জেনে না জেনে বা বুঝে না বুঝে কোনো প্রমাণ ছাড়াই আমাকে নিয়ে পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত থাকার মিথ্যা অপপ্রচার করছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলবো- এই কাজটা ঠিক না। আমিও বাংলাদেশের সব বিবেকবান মানুষের মতো হতভম্ব হয়েছিলাম, স্তম্ভিত হয়েছিলাম। আমিও মানসিকভাবে মর্মাহত হয়েছিলাম। আমিও সত্য জানতে চাই এবং সুষ্ঠু তদন্ত চাই। ভবিষ্যতে পুনঃতদন্ত হলে আমার অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণগুলো বলতে চাই।
প্রায় ১৫ বছর আগের ওই ঘটনা ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে আলোচনায় এসেছে। বিডিআর কল্যাণ পরিষদও এই ঘটনা পুনঃতদন্ত ও ৯ দফা দাবি জানিয়েছে। এ ছাড়া পিলখানায় বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি বিডিআরের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রহিমের কারাগারে মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা করা হয়েছে।
২৫ আগস্ট ঢাকার মহানগর হাকিম মো. আখতারুজ্জামানের আদালতে আব্দুর রহিমের ছেলে এডভোকেট আব্দুল আজিজ এই মামলা করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক বিজিবি মহাপরিচালক ও সাবেক সেনাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পিলখানা বিদ্রোহ মামলার আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজলসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে এ মামলা হয়। মামলায় অন্য আসামিরা হলো- সাবেক কারা-মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম খান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, সংসদ সদস্য শেখ সেলিম, নুর আলম চৌধুরী লিটন, শেখ হেলাল, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম ও হাসানুল হক ইনু। এ ছাড়া ২০১০ সালের জুলাইয়ে দায়িত্বরত কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার এবং কারাগারের চিকিৎসকদেরও আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আরও ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও চাকরিচ্যুত বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদস্যদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছে বিডিআর কল্যাণ পরিষদ। গত সপ্তাহে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিডিআর কল্যাণ পরিষদের উপদেষ্টা ফখরুল ইসলাম বলেন, তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার একটি দেশকে সন্তুষ্ট করতে, সেনাবাহিনীর সামর্থ্য ক্ষুণ্ন ও বাংলাদেশ রাইফেলসকে (বিডিআর) ধ্বংস করে নিজেদের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করতে সুপরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ড’ ঘটিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার পুনরায় তদন্তের কথা বলা হয়েছে।