প্রচ্ছদ সারাদেশ ছোট্ট আয়ানের ডায়েরি: হঠাৎ কারা যেন আসল, গোলাগুলি শুরু হলো

ছোট্ট আয়ানের ডায়েরি: হঠাৎ কারা যেন আসল, গোলাগুলি শুরু হলো

 সারাদেশ: আসমাউল হুসনার দুই হাতের বাধনে শক্ত করে ধরা দুই শিশুপুত্র। ভয়-শঙ্কা-উদ্বেগকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলছিলেন সামনের দিকে। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারলেন না। হঠাৎ ছাত্রলীগ-যুবলীগের ৪০-৫০ নেতাকর্মী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দৌড়ে এসে শুরু করেন গোলাগুলি। তাদের লক্ষ্য সামনে থাকা কোটা সংস্কারের দাবিতে মাঠে নামা শিক্ষার্থীরা। দুই পক্ষের মাঝখানে পড়ে যাওয়া মা তার সন্তানকে নিয়ে কোনোমতে প্রাণ হাতে নিয়ে ঢুকে পড়েন একটি গলিতে। পরে সেখানে একজন অপরিচিত প্রবীণ তাদের ঠাঁই দেন তার বাসায়। পাঁচ ঘণ্টা সেই বাসায় আটকে ছিলেন তারা। সেই ‘বন্দিসময়ে’ অদূর থেকে ভেসে আসা গুলির শব্দে বারবার কেঁপে ওঠে দুই শিশু।

১৮ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট এলাকাজুড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষের সময়ের মুহূর্তের কথা এটি। ছাত্র-জনতা অন্যান্য দিনের মতো জড়ো হয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন। হঠাৎ ওল্টো দিক থেকে এসে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর গুলি ছোঁড়েন। ছাত্ররা তবুও পিছু হটেননি। সেদিনের কয়েকঘণ্টার সংঘর্ষে মারা যান দুই শিক্ষার্থীসহ তিনজন। সেই সংঘর্ষের পর কত কিছু ঘটে গেল। বহু প্রাণের বিনিময়ে পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারেরও। কিন্তু ওই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের স্মৃতি ছোট্ট আহনাফ সরওয়ার আয়ানের মনের ওপর যে গভীরভাবে ছাপ ফেলেছে সেটি বুঝিয়ে দিল ডায়েরির ছোট্ট পাতা। আহনাফ সরওয়ার আয়ান মাত্রই ছয়ে পা দিয়েছে। এখনো প্রথম শ্রেণির চৌকাঠ পেরোচ্ছে। সেই একরত্তি ছেলেটিই সেদিনের গোলাগুলির মুখোমুখি পড়ে প্রাণে বাঁচলেও সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা দুঃস্বপ্নের মতো আহনাফকে বারবার আহত করেছে। সেই ট্রমাময় জীবনে আয়ানের প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছিল বাবার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া একটি ডায়েরি। যেখানে আহনাফ কাঁপা কাঁপা হাতে লিখে রেখেছে ছোট্ট জীবনের সেই ‘স্মরণীয় দিনে’র সবকিছু। ডায়েরির ওপরে আয়ান শিরোনাম দেয় ‘স্মরণীয় দিন, ১৮.০৭.২৪’। তারপর ১৩ লাইনে বড় বড় বাক্যে তুলে ধরে সেই শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত। আহনাফ লেখে, ‘আমরা আজকে নানুকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় থমথমে অবস্থায় ছিল। আসার সময় পড়লাম বিপদে। মুরাদপুরে ছাত্ররা স্লোগান দিচ্ছিল। হঠাৎ কারা যেন আসল। গোলাগুলি শুরু হলো।’ চট্টগ্রাম নগরীর বলিরহাট এলাকার বাকলিয়া ঘাটকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে আহনাফ। তার মা একই বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মা আসমাউল হুসনার কাছ থেকে শোনা যাক সেইদিনের ঘটনাটি।

আসমাউল হুসনা বলেন, ‘১৭ জুলাই আমার মা হঠাৎ করে পড়ে গিয়ে আঘাত পান। তাকে নগরীর জিইসি এলাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন ১৮ জুলাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে করে দুপুর ২টার দিকে দুই ছেলেকে নিয়ে বলিরহাট এলাকার বাসা থেকে বের হয়েছিলাম মাকে দেখতে যেতে। কেননা তখন ইন্টারনেট না থাকায় দেশের পরিস্থিতি সেভাবে বুঝতে পারিনি। আবার টিভিতে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসতে চান দেখে ভেবেছিলাম পরিস্থিতি হয়তো স্বাভাবিকই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বহদ্দারবাড়ি পুকুর পাড় এলাকায় এসে সিএনজিচালিত অটোরিকশা যখন গাড়ি থেকে নামিয়ে দিল তখন বুঝলাম সামনের দিকে কোনো সমস্যা হচ্ছে। এরপর বহুক্ষণ খোঁজে আরেকটি অটোরিকশা পাই। সেটি এক কিলোমিটার হয়ে ঘুরিয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে আমাদের জিইসিতে নিয়ে যায়।’

ফেরার সময়ও গাড়ি নিয়ে একই ভোগান্তিতে পড়েন আসমাউল হুসনা। ছাত্র-পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ মুখোমুখি অবস্থানে থাকায় অটোরিকশাটি আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের মোহাম্মদপুরের প্রবেশমুখে নামিয়ে দেয় তাদের। তখন সেখানে ছাত্র-জনতা জড়ো হয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন। আসমাউল হুসনা বলেন, ‘কিছু পথচারী ফুটপাত ধরে বহদ্দারহাটের দিকে এগোচ্ছিলেন। আমরাও তাদের দেখে সাহস পাই। দুই ছেলেকে দুই হাতে ধরে হাঁটছিলাম। কিন্তু বহদ্দারহাট মসজিদের কাছাকাছি আসতেই দেখি সামনে থেকে ৩০-৪০ জন অস্ত্রশস্ত্র আর দা হাতে দৌড়ে আমাদের দিকে আসছে। তখন সবাই ভয়ে যে যেদিকে পারছে সেদিকে দৌড়াতে থাকেন। আমরা কোনোমতে সেখানকার বদি আলম গলি নামের একটি সড়কে ঢুকে পড়ি। ছেলেরা তখন ভয়ে কান্নাকাটি করছিল। পরে সেখানে একজন প্রবীণ মানুষ আমাদের দেখে তাঁর বাসায় নিয়ে আশ্রয় দেন।’

পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের মুহুর্মুহু গুলির মুখেও বারবার প্রতিরোধ গড়ে তোলে ছাত্রজনতা। থেমে থেমে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে রাত ৮টা পর্যন্ত। যে কারণে আসমাউল হুসনা দুই সন্তানকে নিয়ে ওই বাসা থেকে বের হতে পারেননি। প্রবীণ মানুষটা সেদিন আশ্রয় না দিলে কি যে হতো-এখনো যেন আসমাউল হুসনার চোখের সামনে ভাসছে, সামনে অস্ত্র নিয়ে কিছু মানুষ এগিয়ে আসছে, তিনি বাঁচতে দুই শিশুকে নিয়ে যুদ্ধ করছেন। সেই স্মৃতি থেকে ধার নিয়ে এই মা বললেন, ‘বাবার স্নেহে ওই মানুষ ও তার পরিবারের লোকজন আমাদের নিশ্চিন্তে রাখার চেষ্টা করেন। নানা কথা বলে বারবার শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু বাইরের গোলাগুলির কারণে উৎকণ্ঠা কমছিলো না। ছেলেরাও বারবার গুলির শব্দে কেঁপে উঠছিল। নেট না থাকায় পরিবারের সবার সঙ্গেও যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। পরে রাত ৮টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আমার স্বামী এসে আমাদের নিয়ে যান। যাওয়ার সময় দেখি সড়কের এখানে-ওখানে পড়ে আছে ইটের টুকরো, টিয়ারসেল-গুলির খোসা, ছাত্রদের রক্ত!’ সেদিন ঘটনাটি শেষ হয়ে গেলেও আসমাউল হুসনার ছোট ছেলে আহনাফের মনে তার রেশ রয়ে যায়। বাসায় গিয়ে পুরো ঘটনা সবাইকে তুলে ধরে সে। পরে কোনো এক সময়ে ডায়েরির পাতায় লিখে রাখে স্বচক্ষে দেখা ইতিহাসে নাম লেখানো সেই আন্দোলনের নিজের অভিজ্ঞতা! কদিন আগে দেওয়ান তাহমিদ নামের আহনাফদের পরিচিত এক তরুণ ফেসবুকে সেই ডায়েরির পাতার ছবিটি তুলে ধরেন। এরপর অনেকেই ছবিটি শেয়ার করেন। তবে আহনাফের মা আর স্বজনেরা চান, দ্রুতই আহনাফের মন থেকে এই স্মৃতি বিস্মৃতি হোক। কেননা এই স্মৃতি যে দুঃখজাগানীয়া, যতই মনে রাখবে ততই আহত হবে শিশু-মন। ছেলের মন থেকে বেদনার এই স্মৃতি মুছে ফেলে সেই জায়গাটা কিছু সুখ স্মৃতিতে ভরিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা তাই করেই চলেছেন আহনাফের মা আর বাবা!