
ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির মাঠে গতি ফিরেছে। ক্যাম্পাসের অন্যতম প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল (ছাত্রদল) নিজেদের অবস্থান পাকা করতে শুরু করেছে আগেভাগেই। সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একাধিক পর্যায়ের ছাত্রনেতারা ইতোমধ্যে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
যদিও সাংগঠনিকভাবে এখনও নির্বাচনী প্যানেলের ঘোষণা আসেনি, তথাপি ছাত্রদলের নেতারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনেকে প্রকাশ্যে মাঠে সক্রিয়, কেউবা গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সংগঠনের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ডজনখানেক নেতা এবারের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে লড়ার সম্ভাব্য তালিকায় রয়েছেন।
এদিকে ঢাবি শাখা ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছেন সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন। সাংগঠনিক নেতৃত্ব ও বাগ্মিতার জন্য তিনি বিশেষভাবে জনপ্রিয়। ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের মতে, ভিপি হওয়ার দৌড়ে সবার আগে এগিয়ে আছেন এই ছাত্রনেতা।
এছাড়া ভিপি পদে ঢাবি ছাত্রদল সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহসও লড়তে পারেন বলে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে একচ্ছত্র জনপ্রিয়তা রয়েছে এই ছাত্রনেতার।
পাশাপাশি জিএস বা এজিএস পদে লড়াই করতে পারে বলে জানা গেছে ক্যাম্পাসে শীর্ষ জনপ্রিয় ছাত্রনেতা আবিদুর ইসলাম খান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া এই ছাত্রনেতা ৫ আগস্টের দিন “প্লিজ কেউ কাউকে ছেড়ে যাইয়েন না” এমন উক্তির মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন। সম্প্রতি তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে একটি বইও লিখেছেন, যেটি আগামী জুলাই মাসে প্রকাশিত হবে বলে জানান তিনি।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবারের ডাকসুতে ভিপি, জিএস, সম্পাদক ও সদস্য পদে ২০১৪-১৫ থেকে শুরু করে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত নেতাদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে। জুনিয়ররাও এবার গুরুত্ব পাচ্ছেন, বিশেষ করে যারা ফেস ভ্যালু বা পরিচিতির দিক থেকে এগিয়ে আছেন।
বিশেষভাবে আলোচনায় রয়েছেন ২০১৫-১৬ সেশনের আবিদুল ইসলাম খান এবং ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শেখ তানভীর বারী হামিম। তাঁদের নাম উঠে আসছে ডাকসুর গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রার্থী হিসেবে। একইসঙ্গে ২০১৭-১৮ সেশনের যারা এখনো হলে অবস্থান করছেন, তাদের মধ্য থেকেও হল সংসদের ভিপি পদে মনোনয়নের সম্ভাবনা রয়েছে।
ছাত্রদলের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এবারের ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে দলীয় উচ্চপর্যায়ের কঠোর নজরদারি থাকবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সরাসরি ছাত্রদলের প্যানেল চূড়ান্ত করবেন বলে আভাস মিলেছে। ৫ আগস্টের আগেই যারা ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি রয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে গ্রহণযোগ্য – এমন প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
এদিকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকে ইতোমধ্যে নিজেদের প্রচার কার্যক্রম শুরু করেছেন। কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়, কেউ বা ক্যাম্পাসে সরাসরি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময়ে ব্যস্ত। নির্বাচনের তারিখ এখনও ঘোষণা না হলেও তাদের কার্যক্রম ইতোমধ্যেই ছাত্ররাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
ডাকসুর ৩০ টি পদের মধ্যে ২৮ টি পদে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, যার মধ্যে ভিপি জিএস, ও এজিএস ছাড়াও ১২টি সম্পাদক ও ১৩টি সদস্য পদ রয়েছে। সংশোধিত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত যেকোনো শিক্ষার্থী বা এমফিলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও ডাকসু প্রার্থী হতে পারবেন। এতে বয়স বা শিক্ষাবর্ষের কোনো সীমারেখা রাখা হয়নি।
আলোচিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে রয়েছেন যারা-
২০১০-১১ সেশন থেকে ঢাবি ছাত্রদল সভাপতি আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক;
২০১১-১২ সেশন থেকে ঢাবি সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসিরুদ্দিন শাওন, সহ সভাপতি আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক;
২০১২-১৩ সেশন থেকে ঢাবি সাংগঠনিক সম্পাদক নূর আলম ভূঁইয়া ইমন; ২০১৪-১৫ সেশন থেকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিএম কাওসার, ফেরদৌস আলম, আক্তারুজ্জামান বাপ্পী এবং সাইফ খান;
২০১৫-১৬ সেশন থেকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান, দপ্তর সম্পাদক মল্লিক ওয়াসী উদ্দিন তামী, এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন নূর;
২০১৬-১৭ সেশন থেকে প্রচার সম্পাদক তানভীর হাসান, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক জারিফ রহমান, সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক আবু হায়াত মোহাম্মদ জুলফিকার জিসান, অর্থ সম্পাদক ইকরাম খান, এবং গণসংযোগ বিষয়ক সম্পাদক মানিউল আলম পাঠান শান্ত;
২০১৭-১৮ সেশন থেকে মেহেদী হাসান, ইমন মিয়া, সাইফ উল্লাহ সাইফ, ওবায়দুল্লাহ রিদওয়ান, আরিফুল ইসলাম, ইমাম হাসান অনিক, এবং শরীফ উদ্দিন সরকার;
২০১৮-১৯ সেশন থেকে শেখ তানভীর বারী হামিম, আবিদুর রহমান মিশু, প্রান্ত মাহমুদ, এবং তানভীর আল হাদী মায়েদ।
এছাড়াও মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ, সাইফ খান, মিরাজুল ইসলাম, সাকিব বিশ্বাস, সাইফ উল্লাহ সাইফ, মেহেদী হাসান, রাকিবুল হাসান, সিফাত ইবনে আমিন, মোহতাসিম বিল্লাহ হিমেল, হামিম আল আজাদ, সৈয়দ ইয়ানাথ ইসলাম অছিকুর রহমান জয়, মুজাহিদুল ইসলাম, জোবায়দুল ইসলাম জয়, রিজভী ইসলাম, শোয়াইব ইসলাম অমি, হুমায়ুন কবির, আশরিফান আশিক, সৈয়দ ইয়ানাথ ইসলাম, সাকিব হোসেন, সাব্বির আহমেদ সবুজ, হাবিবুর রহমান, কাজী সুলতান আহমেদ, মাহদিউজ্জামান জ্যোতিসহ বেশ কয়েকজনের নাম আলোচিত হচ্ছে। যারা হল সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারেন।
তবে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক তফসিল ঘোষণার পরই পরিষ্কার হবে কোন নেতা আসলেই মাঠে নামছেন এবং কারা ছাত্রদলের শেষ প্যানেলে জায়গা করে নিতে পারবেন।
ডাকসু নির্বাচন প্যানেল নিয়ে ছাত্রদলের সাংগঠনিক প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক নূর আলম ভূঁইয়া ইমন বলেন, ডাকসু নির্বাচনী প্যানেল গঠনের বিষয়টি সংগঠনের হাই-কমাণ্ড গুরুত্বসহকারে দেখবে। পার্টি যাদেরকে নির্বাচনের জন্য নমিনেশন দিবে তারাই চূড়ান্ত প্যানেল গঠন করবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচন চায় না বলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারে একটি গ্রুপ লিপ্ত আছে বলে মন্তব্য করেছেন সংগঠনটির ঢাবি শাখা সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসিরুদ্দিন শাওন। তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের পর থেকেই একটি গুপ্ত সংগঠন প্রচার করছে ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচন চায় না, কৌশলে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত এটি মিথ্যা অপপ্রচার।
তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী আমলে দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে ডাকসু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ডাকসু নির্বাচন আমাদের প্রাণের দাবি। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও ডাকসু নির্বাচন করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে আলোচনায় বসেছে ছাত্রদল, দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত প্রস্তাবনাও। আমরা ডাকসু নির্বাচন অবশ্যই চাই, এতে কেউ দ্বিমত করেনি। তারপরও একটা গ্রুপ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচন চায় না।
তিনি বলেন, ২০১০-১১ সেশন থেকে শুরু করে ২০২৩-২৪ সেশন পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষাবর্ষেই ছাত্রদলের যথেষ্ট যোগ্য শিক্ষার্থী রয়েছে। যারা ডাকসু নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে জয়যুক্ত হতে পারবে এবং ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতিতে অবদান রাখতে পারবে।