প্রচ্ছদ সারাদেশ এক দিনে ৭ জন নিহত, থানা ঘেরাওয়ের ডাক

এক দিনে ৭ জন নিহত, থানা ঘেরাওয়ের ডাক

সারাদেশ: ৫ আগস্ট বিকাল থেকে দেশের সিংহভাগ মানুষ বিজয়োল্লাসে মেতে উঠলে করলেও স্বজনহারা হাজারো পরিবারে ছিলো কান্নার রোল। এমনই ৭টি পরিবার সিলেটের গোলাপগঞ্জে। শেখ হাসিনা পতনের আগের দিন (৪ আগস্ট) সবচেয়ে বেশি রণক্ষেত্র তৈরি হয় সিলেটের এ উপজেলায়। সেদিন পুলিশ, বিজিবি ও হামলাকারীদের গুলিতে আন্দোলনকারী ৭ জন মারা যান। তবে এই ৭ জনের পরিবারের পক্ষ থেকে দায়েরকৃত মামলার মূল আসামিদের কেউ এখনো গ্রেফতার হননি। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও তারা মূল অভিযুক্ত নন। এ অবস্থায় ৭ হত্যা মামলার মূল অভিযুক্তদের ধরতে ৩ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর’র রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদ। তা না হলে গোলাপগঞ্জ থানা ঘেরাও করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে দলটি। সোমবার (৪ নভেম্বর) রাতে গোলাপগঞ্জ পৌরশহরের চৌমুহনিতে গণঅধিকার পরিষদ উপজেলা শাখা আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে এই আলটিমেটাম দেওয়া হয়।

এদিকে, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে নিহত সাতজনের মধ্যে ছয়জনের লাশ ময়না তদন্তের জন্য কবর থেকে তুলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। এক মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুই মাস আগে লাশ তুলতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত লাশ উত্তোলনের দিন-তারিখ ঠিকই হয়নি। বিষয়টি সম্পর্কে অবগতই নন জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট, আর গোলাপগঞ্জ থানায় দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। ফলে লাশগুলো কবর থেকে উত্তোলন ও সঠিক তদন্ত নিয়ে নিহতদের পরিবারের মাঝে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে- শীঘ্রই লাশ উত্তোলনের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনের সময় সবচেয়ে বেশি উত্তাল ছিলো সিলেটের গোলাপগঞ্জ। ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে পুলিশ-বিজিবি ও আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গুলিতে একে একে প্রাণ হারান ৭ জন। তারা হলেন- উপজেলার নিশ্চিন্ত গ্রামের মৃত তৈয়ব আলীর ছেলে নাজমুল ইসলাম (২৪), দক্ষিণ রায়গড় গ্রামের মৃত সুরই মিয়ার ছেলে হাসান আহমদ জয় (২০), শিলঘাট গ্রামের কয়ছর আহমদের ছেলে সানি আহমদ (২২), বারকোট গ্রামের মৃত মকবুল আলীর ছেলে তাজ উদ্দিন (৪০), দত্তরাইল বাসাবাড়ি এলাকার আলাই মিয়ার ছেলে মিনহাজ আহমদ (২৩) ঘোষগাঁও ফুলবাড়ি গ্রামের মোবারক আলীর ছেলে গৌছ উদ্দিন (৩৫) ও কানিশাইল গ্রামের রফিক উদ্দিনের ছেলে কামরুল ইসলাম (২২)।

এসব নিহতের ঘটনায় গোলাপগঞ্জ থানায় পৃথকভাবে ছয়টি ও আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। সব কটি মামলায় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়। নিহতদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ- নামমাত্র কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করা হলেও মূল আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি মূল অভিযুক্তদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অথচ গ্রেফতার করছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই মামলার সুষ্ঠু কার্যক্রম নিয়ে সন্দিহান ও হতাশ তারা।

এ অবস্থায় সোমবার রাতে গোলাপগঞ্জ পৌরশহরে এই ৭ হত্যা মামলার মূল আসামিদের গ্রেফতার ও তাদের বিচারের দাবিতে সমাবেশ করেছে উপজেলা গণঅধিকার পরিষদ শাখা। সমাবেশে বক্তারা বলেন- আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে পুলিশ যদি খুনিদের গ্রেফতার না করে, তাহলে থানা ঘেরাও করা হবে। নিহতদের স্মরণে গোলাপগঞ্জে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার দাবি জানান বক্তারা। নিহত কামরুল আহমদের বাবা রফিক উদ্দিন বলেন, আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। নিহত তাজ উদ্দিনের মামা আব্দুল মতিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তাজ উদ্দিনের অবুঝ দুই সন্তান তাদের পিতাকে অবিরাম খুঁজছে। আব্বা- আব্বা করে সব সময় ডাকাডাকি করছে। কী দোষ তার? তাকে গুলি করে কেন হত্যা করা হলো? তার খুনিরা কি পার পেয়ে যাবে? নিহত মিনহাজ উদ্দিনের বড়ভাই সাইদ আলম বলেন- আমার ভাই নিহত হওয়ার পর থানায় মামলা করেছি। অথচ পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেফতার করছে না। আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরাফেরা করছে। বিষয়টি রহস্যজনক। আমি আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি। নিহত নাজমুল ইসলামের ভাই সাইফুল আলম বলেন, আমার ভাইয়ের কোনো অপরাধ ছিল না। গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে সে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়েছিল। এজন্য তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদিকে, গোলাপগঞ্জ থানাপুলিশ সূত্রে জানা গেছে- ঘটনা সময় অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে নিহতদের কারও লাশ ময়না তদন্ত করা যায়নি। পরবর্তী সময়ে মামলা হলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা আদালতে লাশের ময়না তদন্তের আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কবর থেকে লাশ তোলার আদেশ দেন আদালত।

এক মাস আগে জেলা প্রশাসন সংবাদমাধ্যমকে জানায়, আদালতের আদেশ পাওয়ার পর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে চারটি লাশ কবর থেকে তোলার জন্য চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নিহত গৌছ উদ্দিনের লাশ তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার জনি রায়কে, নাজমুল ইসলামের লাশ উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হয় জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার জর্জ মিত্র চাকমাকে, হাসান আহমদের লাশ তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয় জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামকে ও সানি আহমদের লাশ উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হয় সহকারী কমিশনার মো. মাসুদ রানাকে। কিন্তু আদালতের আদেশ প্রদানের দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কবর তোলা হয়নি নিহতদের লাশ। এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. নুরের জামান চৌধুরী মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) সন্ধ্যায় সিলেটভিউ-কে বলেন- এ সম্পর্কে আসলে আমি অবগত নই, বলতে পারছি না কিছু।

গোলাপগঞ্জ থানার নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মোল্লা সিলেটভিউ-কে বলেন- আমি এ থানায় মাত্র যোগদান করেছি। তবে শীঘ্রই লাশগুলো উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন- পুলিশের তদন্তের জন্যই লাশগুলো উত্তোলন করা প্রয়োজন। সঠিক ময়না তদন্তের রিপোর্ট না পেলে পুলিশি তদন্তও আগাবে না, ভুক্তভোগী পরিবারগুলোও পাবে না সঠিক বিচার। অপরদিকে, সাতজনের মধ্যে নিহত গৌছ উদ্দিনের লাশ উত্তোলন না করতে আদালতের কাছে আবেদন করেন নিহতের ভাই ও মামলার বাদী মো. রেজাউল করিম। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সিলেটের জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতের বিচারক আবিদা সুলতানার আদালতে তিনি এ আবেদন করেন। তবে শুনানিতে বিচারক আবেদনের নথি সংরক্ষণ করার কথা বললেও কোনো আদেশ দেননি। ফলে গৌছ উদ্দিনের লাশ উত্তোলনের আদেশ বহালই থাকছে।