আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। একসময় বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করা সাবেক এ কূটনীতিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কূটনীতিবিষয়ক সম্পাদক শুভজিৎ রায়কে সাক্ষাৎকারে পিনাক রঞ্জন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে? আমি বলব, আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হওয়ার সম্ভাবনাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। তারা এমন কোনো দল নয় যে অদৃশ্য হয়ে যাবে।
তারা আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে।’
সাক্ষাৎকারে পিনাক বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটবে, আমরা কি তা জানতাম- এমন প্রশ্ন করা হলে উত্তরে বলব, অবশ্যই জানতাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা তার পতন সম্পর্কে অবগত ছিলেন কি না। আমার মনে হয়, এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তিনি অনুমান করেননি।
যদি ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকেন, তবে আপনি অনুভব করবেন, সব কিছু ঠিকই আছে।’
তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট কোটার অনুপাত ৭ শতাংশ করার পর বিক্ষোভ প্রশমিত হবে বলে মনে করেছিলাম। বিক্ষোভ চলাকালে ৩০০ জনের বেশি নিহত হন। বিক্ষোভকারীরা তখন ৯ দফা দাবি নিয়ে ফিরে আসেন।
তারা কয়েকজন মন্ত্রী ও পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগসহ অন্যান্য দাবি করেন। যদিও কেন তারা এসব (দাবি) করেন, তা একটি রহস্য।’
পিনাক রঞ্জন বলেন, ‘এদিকে হাসিনা অবশ্যই তার মন্ত্রীদের বরখাস্ত করতে রাজি হননি, তখন তারা আবারও তাণ্ডব শুরু করেন। এবার অত্যন্ত কার্যকর একটি শক্তি তাদের সমর্থন দেয়। আমার ধারণা, এখানে অন্য প্রভাবগুলো কাজ করেছে- যার বেশির ভাগ বিদেশি এবং কিছু অভ্যন্তরীণ।
’
এটি এত রাজনৈতিক রূপ কেন নিল যে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি পর্যন্ত উঠল– এ নিয়ে তিনি বলেন, এটিও একটি (গুরুত্বপূর্ণ) প্রশ্ন। আমি বলব, সেনাবাহিনী তাকে রক্ষা করতে অস্বীকার করার মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। তারা (হাসিনাকে) জানিয়ে দেয়, তারা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করবে না।
হাসিনার সময়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে পিনাক রঞ্জন বলেন, আগের বিএনপি-জামায়াত সরকারের সঙ্গে ভারতের সমস্যা ছিল নিরাপত্তা ইস্যু এবং পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) সঙ্গে তাদের মৈত্রী। বিএনপি বরাবরই একটু ডানপন্থী এবং পাকিস্তানপন্থী। জামায়াত, অবশ্যই, সব সময় পাকিস্তানপন্থী ছিল, যদিও তারা এখন দাবি করে যে তারা আলাদা। বিএনপিও দাবি করে, তারা বদলে গেছে।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বলেছিলেন, বাংলাদেশের মাটি ভারতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে দেবেন না। সব প্রত্যাশিত কাজ তিনি করেছেন। ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা নিশ্চিত করেন, বিদ্রোহীদের শিবির উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং (তাদের) হস্তান্তর করা হয়েছে। তাই সেদিক থেকে হাসিনা আমাদের কাছে অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যিনি নিরাপত্তার বিষয়টিতে (ভারতের চাহিদা) পূরণ করেন।
‘শেখ হাসিনা আরো বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করা ভালো হবে। আমার মনে আছে, কিভাবে হাসিনা আমাকে প্রথম বলেছিলেন যে তার ভারত থেকে বিদ্যুৎ দরকার। এভাবেই গ্রিড সংযোগের প্রকল্প শুরু হয়। আজ আমরা প্রায় এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করি। আমরা ডিজেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য সরবরাহ করার জন্য নুমালিগড় শোধনাগার থেকে উত্তর বাংলাদেশ পর্যন্ত পাইপলাইন স্থাপনের পরিকল্পনাও করেছি, যা নৌকা এবং অন্যান্য নদী দিয়ে চলাচলকারী কার্গোর জ্বালানি সরবরাহ করার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতিকে সাহায্য করবে। এটি নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় নৌকা ও কার্গো সর্বত্রই যাতায়াত করতে পারে।’
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অসন্তোষ জন্ম নেওয়া নিয়ে পিনাক রঞ্জন সাক্ষাৎকারে অর্থনৈতিক দিক ও কোটা প্রথার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ সরকার বিভিন্ন ধরনের লোক নিয়ে গঠিত। সেখানে রয়েছেন উগ্র ডানপন্থী দল হেফাজতে ইসলামের একজন নেতা। এরপর আছেন বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীলরা। অধ্যাপক ইউনূস আছেন, তিনি একজন বড়, আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। আমি বলব, তিনি অত্যন্ত হাসিনাবিরোধী এবং তিনি (হাসিনা) তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা করেছিলেন। যেমন—অর্থ আত্মসাতের মামলা।’
পিনাক রঞ্জন বলেন, ‘আমার চিন্তা হলো, তারা (সরকারের বিভিন্ন বিভাগ) একসঙ্গে কাজ করতে পারবে কি? এরা সবাই সরকারকে বিভিন্ন দিকে টানতে পারে। উপদেষ্টা পরিষদে দুজন ছাত্রনেতা রয়েছেন এবং স্পষ্টতই, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে তদারকির জন্য দুজন ছাত্র নিযুক্ত রয়েছেন। অবশ্য কিছু ইঙ্গিত এখানে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমাদের অবশ্যই দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাকে (সার্ক) পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তিনি চাইবেন বাংলাদেশ আসিয়ানে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবতা আপনাকে পীড়া দেবে। সব জিনিস আগের অবস্থাতেই রয়েছে: হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছে, দুর্ভাগ্যবশত তাদের আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০০১ সালে বিএনপি–জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসার পরও একই ঘটনা ঘটেছিল।’
ভারতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি প্রসঙ্গও সাক্ষাৎকারে উঠে আসে। ‘শেখ হাসিনা আগেও এখানে ছিলেন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ছিলেন, যখন তার পুরো পরিবারকে রাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি আবার এসেছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে? আমি বলব, আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হওয়ার সম্ভাবনাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। তারা এমন কোনো দল নয় যে অদৃশ্য হয়ে যাবে। তারা আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে।’
পিনাক রঞ্জন বলেন, ‘তাহলে কি হাসিনা ফিরে যাবেন? তাকে মামলা ও তদন্তের মুখোমুখি হতে হবে এবং তারা তাকে জেলে পাঠাতে পারে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যেমনটি করা হয়েছে, প্রতিহিংসার রাজনীতি হওয়ার শঙ্কা প্রবল। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি নতুন নেতা তৈরি করবে? এ সবই কেবল সম্ভাবনার কথা। হাসিনা এখানে থাকবেন কি না, সেটি তার বিষয়। আমি মনে করি না, ভারত সরকার তাকে বের করে দেবে।’
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৭-০৯ সাল মেয়াদে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন পিনাক রঞ্জন। এর আগে তিনি ১৯৯৯-২০০২ মেয়াদে ঢাকায় ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন। সম্প্রতি তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কূটনীতিবিষয়ক সম্পাদক শুভজিৎ রায়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ৫ আগস্টের আগের প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলেন।
সুূুত্রঃ কালের কণ্ঠে