সারাদেশ: ৫ আগস্টের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আন্দোলনে আহতদের পাশে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা ফেরদৌস। দুর্বিষহ সে দিনগুলোর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি। যুগান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পাশে থাকা এ শিক্ষিকা বলেন, আমি মূলত ৫ তারিখের পর থেকে হাসপাতালগুলোতে সক্রিয়ভাবে আহতদের পাশে থেকেছি। প্রথমদিকে আমার সাংগঠনিক কোনো শক্তি ছিলো না। আমি আহতদের ওখানে গিয়েছিলাম। ৫ তারিখের আগে তো রাজপথে আন্দোলন ছিল। তখন থেকেই জানতে পারছিলাম যে হাসপাতালগুলোতে অনেক আহত মানুষ ভর্তি আছে। আন্দোলনের সময় তাই হাসপাতালগুলোতে যাওয়ার খুব একটা সময় হয়নি। ওই একটা অন্যায়বোধ কাজ করতো। যে কারণে ৫ তারিখের পর থেকে আমি ঢাকা মেডিকেলে ছিলাম।
তিনি বলেন, আমি গিয়ে প্রথম যেদিন দাঁড়াই, আমার জীবনে এই বাস্তবতা না দেখলে বোধহয় ভালো হতো। এ বাস্তবতা যে কত করুণ কত দুর্বিষহ, এটা যে ওই সময় হাসপাতালে না গিয়েছে সে বুঝবে না। আহতদের ক্ষত তখন একবারে দগদগে, বুলেটের আঘাত যে কত তীব্র হয়, কারো চোখে স্প্লিন্টার, কারো পুরো শরীরে রাবার বুলেট। বৃদ্ধ থেকে শুরু করে ছোট শিশু কেউ তো বাদ যায়নি। শিক্ষার্থীরা ছাড়াও অনেক মানুষ আহতদের পাশে ছিলে জানিয়ে সায়মা ফেরদৌস বলেন, আইসিইউ ইউনিটেও অনেক রোগী ছিল। তখন তো একবারে ছন্নছাড়া অবস্থা। আমাদের ছাত্র-ছাত্রী কিছু ছিল বাকি আরও ৪০ জনের মতো শুরু থেকেই কিছু মানুষ সমন্বয় করছিল। ওরা যা করেছে আমি এই প্রজন্ম নিয়ে গর্ব করি।
আহতদের অবস্থা বর্ণনা করে তিনি বলেন, আমি যখন হাসপাতালে গেলাম, কী বীভৎস অবস্থা। একটা ছোট ছেলের কথা বলি, ওর নাম মুসা। ৯ বছরের ওই শিশুটি আইসিইউতে ছিল। ওর দাদুরও গায়ে গুলি লেগেছিল। তিনি তখনই মারা যান। ওর কানের পাশে গুলি লেগেছিল। অপারেশনের সময়ও বুলেটটি ছিল। বাচ্চাটার পাশে আমি যখন দাঁড়িয়েছি, ও তখন আস্তে শুধু চোখ খুলতে পারে। প্রথম দিকে আমাদের আশা ছিল যখন পুরোপুরি জ্ঞান ফিরবে হয়তো বা শিশুটি কথা বলবে। ১৫ দিন পর বাচ্চাটা চোখ খুলেছে কিন্তু সে নিথর। অসার শরীর। কোনো কথা বলে না। ওর মা যখন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে, তাকে আমি কি উত্তর দেব? মা বলছেন, আমার একটাই চাওয়া আমার বাচ্চাটা যেন কথা বলে। আর কোনো চাওয়া নাই। একটা ছেলেকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মাথার খুলি আলগা করা- এগুলো কোন বাস্তবতা? একটা ছোট ছেলের মেরুদণ্ডে অসংখ্য স্প্লিন্টার। একজন রিকশাওয়ালার ফুসফসে পর্যন্ত গুলি লেগেছে। আবেগাপ্লুত হয়ে ড. সায়মা ফেরদৌস বলেন, যে ছেলেটা দুটো পা হারাল, বার্ন ইউনিটে আরও বীভৎস অবস্থা ছিল। এগুলো দেখে সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। আমি এদের জন্য কিছু করতে পারিনি, শুধু তাদের জড়িয়ে ধরতাম। এ মানুষগুলোর আত্মত্যাগ, এগুলো যেন জাতি ভুলে না যায় এ জন্য যা যা করার আমি করব। তাদের যা ক্ষতি হয়েছে এগুলোর বিনিময়ে কোনো কিছুই যথেষ্ট না।
সূত্র: যুগান্তর